আঁতমোড়া, Helicteres isora
আগাগোড়া রহস্যে মোড়া আঁতমোড়া
মোহাম্মদ আলি
শংকরযাঁতা, শংকরযাতা, শংকরজাতা--কোনটি সঠিক? ভাবছেন আঁতমোড়া লিখতে বসে অন্য গাছের পাঁচালি কেন? আসলে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া হয়নি, একটা জট খোলার জন্যই এই প্রাসঙ্গিকতা। আমাদের উদ্ভিদ পরিচিতিমূলক সাহিত্যের প্রায় পুরোটাই ইংরেজিতে রচনা, এটা আমরা বেশ ভালো করেই জানি। উপমহাদেশ তথা এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য এলাকার উদ্ভিদগুরু ইংরেজ ড্যালটন হুকারসহ আরো অনেকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকারের ছত্রছায়ায় তাদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে তা রচনা করবেন, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ধারা থেকেই এখনো উপমহাদেশীয় গাছগাছড়াগুলোর ইংরেজি নাম আমরা পাচ্ছি। যে গাছগুলোর স্থানীয় নাম আগে থেকেই জনপ্রিয় তারা সেগুলো বসিয়েছেন ওই ইংরেজি হরফেই। আবার এমনও অনেক দেশজ গাছ রয়েছে যেগুলোর স্থানীয় নাম পাওয়া যায়নি, ইংরেজি নামেই এখন পর্যন্ত প্রচলিত। যেমন, দুটি গাছের কথা বলি : একটি লতা, নাম Nepal Trumpet Vine (Beaumontia grandiflora) অন্যটি গুল্মলতা, নাম Ladies Umbrella বা Chinese hat plant (Holmskioldia sanguinea)। উদ্ভিদগুরু দ্বিজেন শর্মা তাঁর শৈশবের বন (মৌলভীবাজারের বড়লেখা) থেকে তুলে এনে ঢাকার রমনা পার্কে এ দুটি লাগিয়েছেন এবং বহাল তবিয়তে এখনো এরা রয়েছে। কথা হল, আমাদেরই বনের গাছ, অথচ কোনো বাংলা নাম এর পাওয়া যায়নি, ইংরেজি নামে এরা পরিচিত এখনো। তবে বাংলা নাম না পাওয়া গেলেও স্থানীয় বনচারী গারো, খাসিয়া, চাকমা, মারমার মতো জনগোষ্ঠীরা এদেরকে কোনো না কোনো নামে ডাকে বলে অনুমান করতে পারি। ভুলে গেলে চলবে না, ঔষধি গাছগাছড়া নিয়ে বাংলা বা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু রচনা আমাদের দেশে একসময় প্রচলিত ছিল এবং ভঙ্গুরভাবে হলেও এখনও তা আছে। সে রচনা থেকে যদি স্থানীয় নাম পাওয়া যায় তাহলে সেগুলো দিয়েই পরিচিত হোক আমাদের প্রাকৃত গাছেরা।
যেটা বলছিলাম, ইংরেজিতে রচিত উদ্ভিদসাহিত্যে Sankarjata তো বাংলায় মনের মাধুরী মিশিয়ে শংকরযাঁতা, শংকরযাতা, শংকরজাতা ইত্যাদি নামে পর্যবসিত হবেই। আসলে গাছটির সঠিক নাম শংকরজটা। মানে, শংকর বা শিবের চুলের জটার মতো গাছটির কোনো একটি অঙ্গ যে থেকে থাকবে, তা বোঝা যাচ্ছে; সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আমাদের এই আঁতমোড়ার কপালেও কিন্তু এই শব্দজটের অপবাদ জুটেছে। ইংরেজিতে Atmora লেখা হয় বলে বাংলায় এর কপালে জুটে গেছে আটমোড়া নাম। ইংরেজিসহ যেকোনো ভাষার উচ্চারণ ঠিকভাবে বোঝার জন্য ধ্বনিবিজ্ঞানীরা কিন্তু International Phonetic Alphabet নামে এক অনন্য উচ্চারণকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। ইংরেজিতে উদ্ভিদবিদ্যার চর্চা যারা করছেন তাদের প্রতি অনুরোধ রইল স্থানীয় নাম দেয়ার ক্ষেত্রে তারা যাতে এই পদ্ধতির ব্যবহার করেন।
শুরুতে বলে রাখি, আমাদের এই আঁতমোড়া কিন্তু দারুণ ঔষধি এক গুল্ম। যে কারণে ঔষধি বাগানে 'অবশ্যই রোপিত' গাছের একটি এটি। এর আরও দুটি বাংলা নাম রাজট ও পিচরঙ্গী। বৈজ্ঞানিক নাম Helicteres isora, পরিবার Sterculiaceae। ঔষধি গুণের কথায় পরে আসি, আগে এর নামজটটা আরেকটু বিশদভাবে খোলার চেষ্টা করা যাক। আঁতমোড়া শব্দটি, বলা ভালো, শব্দের প্রথম অংশ এসেছে সংস্কৃত শব্দ আবর্তকী বা আবর্তনী থেকে--এ-ই ধারণা করা হয়। ভারতের উড়িষ্যা অঞ্চলে গাছটির নাম মুরমুরিয়া বা মুরমুরি। আঁতমোড়া নামের পেছনে এ শব্দদুটিরও অবদান থাকতে পারে বলে এক আকরগ্রন্থপ্রণেতা পণ্ডিত মনে করেন।
এ তো গেল পণ্ডিতদের কথা, আমি ভাবছি লোকমুখে এর নামের বিবর্তনরহস্য নিয়ে। এর ফল দেখতে যেহেতু মোড়ানো বা প্যাঁচ-মারা, হয়ত এ কারণেই গাছটির নাম লোকেরা দিয়েছে আঁতমোড়া। শুধু এ-ই নয়, ফলের ছবি দেখে এর প্যাঁচ কয়টি গুনতে বসে গেলাম; মনে আশা, এর প্যাঁচের সংখ্যা ৮টি-ই হবে। কিন্তু মনের পাখি আর বনের পাখি তো আর এক হয় না, আশা ছেড়ে দিয়ে আঁতমোড়ার প্রথম অংশ নিয়ে ভাবি। আমরা জানি আঁত শব্দটি দিয়ে আমরা মূলত প্রাণিদেহের অন্ত্র, আঁতুড়ি বা নাতিভুঁড়িকে বুঝিয়ে থাকি। তাহলে আঁতের মতো মোড়ানো ফলের কারণেই গাছটির নাম আঁতমোড়া? নাকি অন্ত্ররোগে এ গাছটির ব্যবহার রয়েছে বলে এর এমন নাম?
আঁতমোড়া আমাদের পত্রমোচী শালবনের প্রাকৃত গাছের একটি। লম্বা লম্বা ছড়ানো ডালের গুল্মটি ছোটখাটো গাছের আকারও পেতে পারে আকন্দ কিংবা হরকুচকাঁটার মতো। এর গোড়া কাষ্ঠল, ডালপালাও তাই। ৩-৮ মিটারের মতো উচ্চতা পায় গাছটি। কাণ্ড ও ডালপালা, বিশেষ করে কচি ডালপালা গুচ্ছাকার, খসখসে রোমে আবৃত। কাণ্ড ধূসর রঙের।
পাতাগুলো পত্রাক্ষের দুদিকে থাকে একান্তরবিন্যাসে (একটির পর একটি, একই উৎসের বিপরীত দিক থেকে নয়)। একেকটি পাতা বিডিম্বাকার (গোড়ার দিকে সরু), কিংবা গোলাকার, গোড়ার দিকে অসমানভাবে হৃদাকৃতির, আগার দিকে সামান্য চোখা, কিনারা অসমানভাবে কর্তিত বা দন্তর। পাতার উপরের দিক খসখসে, নিচের দিক রোমশ; ৮-১২ সেমি লম্বা, ৫-১০ সেমি চওড়া। বোঁটা ১.৫ সেমি লম্বা। এটিও রোমশ। উপপত্র রয়েছে, প্রায় ১ সেমি লম্বা, আশুপাতি (দ্রুত ঝরে যায়)।
ফুল দেখতে বেশ সুন্দর, একবার দেখলে ভোলার উপায় নেই। মূলত লাল রঙের, তবে একই গাছে বেগুনিও হয়। বেগুনি কেন হয়, সে রহস্য লেখার শেষ দিকেই বলি। ফুল মূলত কাক্ষিক, রোমশ, একক কিংবা ২-৬টি এক মঞ্জরীতে। বৃতি নলাকার, ১.৫-২.৫ সেমি লম্বা, খণ্ডক ৫টি, অসমান, রোমশ। পাপড়ি বাইরের দিকে প্রসারিত, বৃতিনলের দিকে মোড়ানো; দুই স্তবকে ভাগ করা, ২টি বড় বাকি ৩টির চেয়ে। পুংকেশর ১৫টি, ফুল ছেড়ে বাইরের দিকে প্রসারিত, ৩-৪ সেমি লম্বা। ফুল ফোটা শুরু হয় গরমে--মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যসূচক ফলের জন্যই গাছটির নাম আঁতমোড়া। ফল শুষ্ক-বিদারী (follicle), ৪-৫ সেমি লম্বা, ১ সেমি চওড়া, প্যাঁচানো বা মোড়ানো, মুখের দিকে সুঁচালো ও বাঁকানো। বীজ অনেকগুলো, কুঞ্চিত, মিহি রোমযুক্ত। ফল পাকে শীতে। সাধারণত দুই বছর বয়সে এর গাছে ফুল-ফল আসে। বংশ বৃদ্ধির কাজটি চলে বীজের মাধ্যমে। তবে শিকড় থেকে গজানো চারা থেকেও গাছ হয়। এক সূত্রমতে, এর বীজ ফলসমেত সারারাত পানিতে ভিজিয়ে পরদিন পুঁতলে সহজে চারা তৈরি সম্ভব হয়।
আঁতমোড়ার ভেতরের ছাল থেকে দামি সাদা ও সবুজ রঙের আঁশ পাওয়া যায়। গাছের ছালসহ অন্যান্য অংশ দিয়ে কাগজ তৈরি করা যায়। গবাদি পশু এর পাতা ও কচি ডালপালা খায়। জ্বালানি হিসেবে এর কাঠ ব্যবহৃত হয় কোথাও কোথাও। বারুদ তৈরিতে এর ছাই ব্যবহার করা হত একসময়।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, দক্ষিণ চীন ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে এর দেখা মিলবে। দেশে বাস্তুভিটা সম্প্রসারণের জন্য দিন-দিন গাছটি বিরল হয়ে পড়ছে। টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বনগুলোতে এখনো এর কিছু কিছু গাছ দেখতে পাওয়া যায়। আশার কথা, একে সযত্নে চাষ করা হয় আমাদের ঔষধি বাগানগুলোতে।
এর ঔষধি গুণের কোনো শেষ নেই। খাবারে অরুচি, বদহজম, পেটফাঁপা, পেটব্যথার ক্ষেত্রে এর ফল ভেজে মিহি গুঁড়া করে প্রয়োগ করা হয়। বাচ্চাদের কৃমিরোগেও এর ব্যবহার রয়েছে। এর ফলে নাকি যৌনশক্তিবর্ধক গুণ রয়েছে। আবার এও বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সেবনে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে তা। শিকড়ের ছালের রস মায়েদের বুকের দুধ কমায়। শিকড় কফ, কাশি, সর্দিতে ব্যবহৃত হয়। খোস-পাঁচড়াতেও এর ব্যবহার রয়েছে। আঁতমোড়ার আঁশ অনেকটাই পাটের আঁশের মতো দেখতে। আর পাটের আঁশের চাইতেও তা টেকসই, স্যাঁতসেঁতে স্থানে রাখলে সহজে পচেও না। ভারতের দক্ষিণে এর আঁশ দিয়ে বস্তা বানানো হয়।
সবশেষে এর আরো একটি রহস্যের কথা বলা যাক। আঁতমোড়ার দুই রঙের ফুল হয়, একটি লাল, অন্যটি নীল। এক সূত্র জানাচ্ছে, এর লাল ফুলজাত ফলের প্যাঁচ থাকে বামদিকে আর নীল ফুলজাত ফলের প্যাঁচ বামদিকে। দারুণ অবাক-করা তথ্যই বটে! রহস্যের প্রথম জটটি খোলা গেছে এক সূত্র ধরে। সেখানে দুই রঙের ফুলের জট সম্পর্কে লেখা আছে, পোকামাকড় দ্বারা এর ফুল আক্রমণের শিকার হলে তা নীলরঙ ধারণ করে, যে-কারণে একই গাছে দুই ধরনের ফুল ফোটে বলে মনে করা হয়। আর দ্বিতীয় রহস্য? মানে কিনা ডান-বাম দুদিকে প্যাঁচ-মারা ফলের রহস্য; যদি তা-ই হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তা ভেদ করার আশ্বাস রাখি।
উল্লেখ্য, অন্ত্রের রোগ ও গ্যাস্ট্রিকে এর ফলের ব্যবহার রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও কোথাও।
Comments
Post a Comment