কেশরদাম, Ludwiga ascendens

শৈশব-দাম দিয়ে কেনা কেশরদাম

মোহাম্মদ আলি

কেশরদামের ফুল সুন্দর। পাতা সুন্দর। জলীয় পরিবেশে আলো করে পানি কিংবা কাদামাটির ওপর এর ছড়িয়ে থাকাটা আরো সুন্দর। 

একটু কুয়াশা, একটু বিভ্রান্তি আছে কেশরদামের জন্মভূমি নিয়ে। কোথাও বলা হচ্ছে এর জন্ম দক্ষিণ এশিয়ার ভেজা পরিবেশে, আবার কোথাও বলা হচ্ছে হয়তো দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এর জন্মভূমি। আসলে এ বৈজ্ঞানিক বিতর্ক; অবসান হলে ভালো--যে দেশের হবে সে দেশ একে নিয়ে গর্ব করতেই পারে। প্রথমে বলার চেষ্টা করেছি রূপে সে সর্বাঙ্গসুন্দর, গুণে কী, সে পরের কথা। সব তর্ক ছাড়িয়ে স্বজ্ঞা বলে, এ আমাদেরই রোদনভেজা বাংলার, রূপসী সবুজ বাংলার।

অবশ্য স্বজ্ঞা তো অনেক সময় নিজের তৈরি অনুমানমাত্র। ঢোলকলমিকেও আমাদের মনে হয় গ্রামবাংলার একান্ত গাছ; তা তো নয়, এ তো মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গাছ। তথ্যটি শোনামাত্র অনেককে হায়-হায় করতেও দেখেছি। উৎপত্তির এ জট-খোলা খেলার অবসান ভবিষ্যতে হবে, এ আাশাবাণী রেখে এখন চলুক কেশরদামকীর্তন।

কেশরদাম নামটা কেমন একটা রহস্যময় যেন। অজ্ঞতা রহস্যের একটা অন্যতম বড় বিষয়, এ ফাঁকে বলে রাখি। ঢাকাশহরে বড় হওয়া এই আমি গ্রামবাংলার সহজপ্রাপ্য গাছটির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবেই পরিচিত। কে না জানে শৈশবস্মৃতি মানুষজীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতির একটি। বিপুল-বিশাল এই যন্ত্রশহরের রূপ তো এমন ছিল না তিন দশক আগেও। এ জনপদের অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতোই, ছিল সবুজবহুল, পানিবহুল এক জনপদ, বাংলার অন্যান্য এলাকার মতো। নদী ছিল (এখনো আছে) এর চারদিক ঘেরা; খাল ছিল অনেকগুলো, যেগুলো বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ দিয়ে ছিল শাখায়িত। আর এ জলাধারগুলোর চারদিকে ছিল অসংখ্য ডোবা, নালা, পুকুর। এমনই এক এলাকা ছিল শৈশবের মগবাজার। এই যে প্রতাপশালী সৌন্দর্যের আধার হাতিরঝিল প্রকল্প, এটিরই বুকের নিচে ছিল জলাভূমি। এখনো আছে, তবে তা কোনোরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। হাতিরঝিলের খালটা পুবে-পশ্চিমে ছিল বেশ দীঘল। এ প্রকল্পের বাইরে হাতিরঝিলের এ খালকে আগে থেকেই উধাও করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ৯০ ফুট খালকে ৯ ফুট সুয়ারেজ-নল দিয়ে রাস্তা ও বাড়িঘরের নিচ দিয়ে ঢাকার পশ্চিমে বুড়িগঙ্গায় এ খালকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

দিনে দিনে অনেক আগে থেকেই মানববর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য এই হাতিরঝিলে স্তূপায়িত থাকত, যে-কারণে শীতকালে দুর্গন্ধে ভরে যেত এর আশপাশ। কিন্তু যে অমূল্য স্মৃতির বাসিন্দা হয়ে আছি, সে তো এ খালের কারণেই। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম তার পাড়েই ছিল এ খাল। বর্ষায় এর পাড়ে ও পানিতে জন্মাতো দুনিয়ার সব জলজ গাছগাছড়া--মালঞ্চ, সাঁচি, হেলেঞ্চা, কচুরিপানা, টোপাপানা, কপিপানা, সুজিপানা, বড়নুখা, ছোটনুখা, থানকুনি এবং আরো অনেক জলজ ঘাস ও লতাবীরুতের সাথে আমার শৈশবের এই কেশরদাম। তখন কি আর এর নাম জানি! রূপেও মুগ্ধ হতাম না হয়ত, কিন্তু পরিণত এ বয়সে যখন একে দেখি তখন ছোটবেলার সেই স্মৃতি ঝপ করে বর্তমানের কেশরদামের সাথে একাট্টা হয়ে যায়। এর নান্দনিক জলে-ভাসা রূপ মনে এখনো যে দোলা দেয়, তা ঠিক বলার নয়। আমার মনে আছে, কোমলাঙ্গীর ফুলের পাপড়িগুলো আশুপাতি, মানে, দ্রুতই পড়ে যেত, হাতের ছোঁয়া পেলেই গেল! আমরা ছেলেমেয়ের দল যখন চড়ুইভাতি খেলতাম তখন এ ছিল আমাদের সঙ্গী। এর পাতা ও ডাল দিয়ে মাটি কিংবা এলুমিনিয়ামের খেলনা-হাঁড়িতে মিছামিছি তরকারি বসাতাম। ফুলকপি হিসেবে থাকত কালোকেশীর কচি ফল, আরো থাকত বক্কনের ফুলফল। বছর-কয়েক আগে কেরানীগঞ্জের এক বিললগ্ন বদ্ধ জলায় আধনিমজ্জিত নৌকার ওপর ওর যে রূপ দেখেছি, তা চোখের আলো দিয়ে মনের কোণে যেভাবে চিত্রিত আছে, তা তো চিত্রছবিতে কোনোভাবেই ফুটে উঠবে না নিশ্চিত।

ভুঁইফোঁড় জলজটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর কাণ্ড বা শাখাপ্রশাখার গাঁট বা কোণ থেকে গুচ্ছবদ্ধ খাড়া খাড়া শিকড় গজায়। কাণ্ডটি এর সবুজ কিংবা লালচে, কিছুটা ফাঁপা, যার মাধ্যমে সে সহজে পানিতে ভেসে থাকতে পারে। খুব একটা বড় হয় না বহুবর্ষজীবী কোমল এ প্রসারণীটি। অনুমান, কলমিলতার মতো এর বিস্তারের সীমাপরিসীমা, তার চাইতে কমও হতে পারে। এই কলমি কিন্তু আমাদের কেশরদামের আদর্শ সহচর। এ ছাড়াও বড়নুখা, হলদেপানা, কচু, বনলবঙ্গ, কচুরিপানাসহ নানা জাতের শাপলা আর জলজ গাছগাছড়ার প্রতিবেশি সে। স্থাপনা তার ডাঙ্গায় কিংবা ভেজা অংশে, বিস্তার পানিতে, অগভীর পানিতে। বিস্তৃত হলে গভীর পানিতেও এর শরীর ভাসে। শুধু যে ভাসে, তাও নয়, ঐ ভাসমান অবস্থায় পর্বসন্ধি থেকে বের হওয়া ডালগুলো নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক সময়। মজার ব্যাপার হল, এর শাখাপ্রশাখা ভাসমান অবস্থায় রোমহীন বা মসৃণ থাকে, আর শুকনো জায়গায় জন্মালে তা হয়ে যায় রোমশ। 

পাতার সৌন্দর্য আগেই বলা হয়েছে। এগুলো সরস, কিছুটা পুরু, মটকালে ভেঙে যায়, সরল, আয়ত-গোলাকার, ৪ সেমি লম্বা, ২ সেমি চওড়া, আগা ভোঁতা; একান্তরবিন্যাসী, শিরাগুলো সহজদৃষ্ট; সবৃন্তক, ১.৫-২ সেমি লম্বা।

ফুল সাদা, শাখার কোণে (কাক্ষিক) সাধারণত একটি ধরে, বড় বোঁটাযুক্ত, পাপড়িসংখ্যা ৫, আশুপাতি। পাপড়ির গোড়ায় হলুদ চিহ্ন রয়েছে, যে-কারণে পুরো ফুলের দিকে তাকালে মাঝখানটায় হলুদ মণির মতো আভা তৈরি করে। ফুল ৪ পর্যন্ত সেমি চওড়া। বৃত্যাংশ ৫। পাপড়ি বিডিম্বাকার, আগার দিকটা গোলাকার। পুংকেশর ১০টি, হলুদ রঙের, গর্ভদণ্ড পুংকেশরের চাইতে বেশ বড় ও ষ্ফীত। এটিও হলুদ রঙের।  

মনে প্রশ্ন জাগে, এই পুংকেশরগুলোর (গর্ভদণ্ডসহ) জন্যই কি গাছটির নাম কেশরদাম? কেশরের ঘনঘটা ও হলুদ চোখের জন্য নাহয় এর নামের প্রথম অংশটা আসতে পারে, কিন্তু শেষের অংশ? এই শেষের 'দাম' শব্দের অর্থ গুচ্ছ বা দঙ্গল, অর্থাৎ একসাথে অনেকগুলো। কিছু হলেই কোনো একটি উদ্ভিদের নামের পিছনে 'দাম' শব্দটা আমরা যোগ করে দেই, যেমন ঝাঁঝিদাম, কলমিদাম, কচুরিদাম, ইত্যাদি।

ফল ক্যাপসুলাকার, ১-২ সেমি লম্বা, মসৃণ, আবার রোমশও। ১০টি শিরায় চিত্রিত। বহুবীজী ফলগুলো ঠিক নিয়ম করে শিরা ধরে ফাটে না। বীজ মসৃণ, বেগুনি-বাদামি। ফুল ও ফল প্রায় সারা বছর; আরো স্পষ্ট করে বললে মার্চ থেকে ডিসেম্বর। ভাসমান কাণ্ড ও বীজের মাধ্যমে এর বংশবৃদ্ধির কাজটি চলে।

বাংলাদেশের কৃষিজমি, জলা, খানাখন্দক, খালবিলে এখনো অঢেল রয়েছে কেশরদাম। স্বদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এর দেখা মিলবে। আরো মিলবে আধা ও পুরো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাতেও। এর বিশাল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এর জন্মস্থান নিয়ে এত বিভ্রান্তি।

বাংলার চাষিদের কাছে আগাছা হিসেবে খেতাব জুটলেও এর কিছু ঔষধি গুণপনা রয়েছে। বিভিন্নরকম চর্মরোগে একে ব্যবহার করে লোকায়ত চিকিৎসকরা। পাপড়ির রস চামড়া পোড়াজনিত জ্বলুনিতে ব্যবহৃত হয়। আলসারেও এর ব্যবহার রয়েছে। 

এর ঔষধি নামটা এতক্ষণ বলিনি ইচ্ছা করেই, নামরহস্য একটু ঘনীভূত করলে সমস্যা কী? লেখার শেষে ভাবতে থাকুন নিচের তথ্যটির সাথে আপনার ভাবনা মেলে কিনা। সংস্কৃতে এর নাম 'কঞ্চট'। এ শব্দটি সময়ে 'কাঁচড়াদাম' হয়ে 'কেশরদাম'-এ রূপান্তরিত হল কিনা, প্রশ্ন আমারও। 

আমাদের দেশে কেশরদামের বেশ কয়েকটি ডাকনাম রয়েছে; এগুলো মালচা, মালসি, পানিডোগা, দিওহেঞ্চি। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ludwigia adscendens, পরিবার Onagraceae। Creeping Water Primrose এর প্রধান ইংরেজি নাম।


ছবি : নিজ

Comments

Popular posts from this blog

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

রসুন, Garlic, Allium sativum