শিলকড়ই, Albizia procera
শিলকড়ই : বাংলাদেশের অন্যতম নয়নসুখ বৃক্ষ মোহাম্মদ আলি
কত রকমের শিরীষ আর কড়ই যে আছে আমাদের দেশে! এই যে সারা দেশে ছড়িয়ে যাওয়া প্রতাপশালী রেইনট্রি, যা লোকমুখে রেন্ডিকড়ই, অনেকেই একে জানে কড়ই গাছ হিসেবে। অনেকে আবার গগন শিরীষকেও কড়ই বলে মনে করেন। এসব কড়ই বা শিরীষের কাছে আমাদের স্বদেশি কড়ই বা শিরীষ যেন অপাঙক্তেয়; অনেকেই আমরা ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখা’র শিরীষ বলতে বুঝে থাকি এই রেইনট্রিকে (Samanea saman)। আসলে ফ্যাবাসি (Fabaceae) পরিবার, আরো স্পষ্ট করে বললে অ্যালবিজিয়া (Albizia) গণের গাছগুলোর পাতা, ফুল, ফল, দেহগঠন কিছুটা কাছাকাছি হওয়াতে এ সাধারণ বিভ্রান্তি। বলে রাখা ভালো, শিরীষের দ্বিপদী নাম Albizzia lebbeck, মাঝারি থেকে বড় আকারের গাছ। এর ফুল যখন ফোটে তখন ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ অবস্থা তৈরি হতে বাধ্য--এতই যার ফুলের গন্ধ। এ তো গেল শিরীষ; প্রশ্ন আসে, আসল কড়ই তাহলে কোনটি? সত্যিকার অর্থে, আলোচ্য এ শিলকড়ই-ই হচ্ছে আমাদের আসল কড়ই। নামবিভ্রান্তির কারণে একে বলতে হচ্ছে শিলকড়ই, দেশি কড়ই, সাদা শিরীষ, সাদা কড়ই, লোহা শিরীষ, জাতকড়ই, ঝুনঝুনা কড়ই, ইত্যাদি।
শিলকড়ইয়ের প্রসঙ্গ আসলে একটা প্রশ্ন মনে সবসময় আসে; প্রশ্নটি হল, কেন এর নাম শিলকড়ই? কাঠ খুব শক্ত আর টেকসই বলেই শিলপাথরের সাথে তার এমন তুলনা? সত্যিই এর কাঠের তুলনাই যেন আর হয় না। দারুমূল্যের এ ব্যাপারটিতে আমরা পরে আসছি।
শিলকড়ই আকারে বিরাট বৃক্ষ, পাতাঝরা বৃক্ষ। গাছটির দ্বিপদী নাম Albizia procera। শেষের অংশ procera-এর অর্থ লম্বা বা উঁচু। সত্যিই এটি বাংলাদেশের উঁচু বৃক্ষের অন্যতম। সাধারণত এর ১৫-২০ মিটারের মতো উচ্চতার গাছ আমরা চারপাশে দেখে থাকি, তবে অনেক ক্ষেত্রে তা ৪০ মিটারেও যেতে পারে। এর পরিণত গাছের কাণ্ডের বেড় হতে পারে ২.৫ মিটার পর্যন্ত। এর চাঁদোয়া বেশ ছড়ানো। কাণ্ড হলদেটে সাদা, মসৃণ। ডালপালার রঙও কাণ্ডের মতো। তবে কচি ডাল আরো সাদা, মিহি রোমযুক্ত। গায়ের পাতলা শল্ক গাছটি মোচন করে অর্জুন কিংবা ইউক্যালিপটাসের মতো। ৩ থেকে ৪ বছরের মাথায় ৪ মিটারের মতো উঁচু হয়ে এটি ফুল দেয়া শুরু করে। বাঁচে ৩০-৪০ বছরের মতো।
দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রাকৃত বৃক্ষ শিলকড়ই। রূপ ও গুণের খ্যাতির জন্য সারা বিশ্বের উষ্ণ ও অর্ধোষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। এখনো আমাদের দেশের পাহাড়ি বনে অঢেল আছে দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষটি। পাতা ঝরার সময় পাহাড়ে গেলে একটা দৃশ্য চোখে পড়বেই; সেটি পাহাড়ের ঢালে থাকা পাতাশূন্য গাছে ধরা এর অজস্র-অগণন তামাটে ফল। ফল ছাড়াও দৃষ্টিসুখ সাদাটে কাণ্ড তো রয়েছেই। পাহাড়ি বন ছাড়াও কম-বেশি রয়েছে শালবনগুলোতে। আর রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জমির পাশে, বাড়ির প্রাঙ্গণে, রাস্তার পাশে ও উদ্যানগুলোতে। শুধু কাণ্ড নয়, পাতাবাহুল্য, পাতার গড়নবরন, ডালপালার বিন্যাস, ছায়া দানের ক্ষমতা, ফলের প্রাচুর্য ও এর রাঙা আভা একে দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষের তকমা।
শিলকড়ইয়ের পাতা দৃষ্টিসুখকর। সবুজ পাতার কোলে সবসময়ই কচি পাতারা ভিড় করে থাকে। এর পাতা দ্বিপক্ষল, অর্থাৎ প্রাথমিক পত্রাক্ষের মধ্যে আরেক পত্রাক্ষ থাকে। প্রধান পত্রাক্ষ ৩০-৩৫ সেমি লম্বা; ৪-৬ জোড়া উপপত্রাক্ষে পাতাফলক থাকে ৪-১০ জোড়া। ফলকের আকৃতি উল্টো-আয়ত-ডিম্বাকার, ২.৫-৩ সেমি লম্বা, সবৃন্তক, বৃন্ত ১ সেমি-এর একটু বেশি। পত্রাক্ষে পাতার বিন্যাস বিপ্রতীপ, অর্থাৎ একই বিন্দু থেকে জন্মায় পাতাজোড়া। পাতার মধ্যশিরা একপেশে, পাতার মাঝ-বরাবর নয়। ফ্যাবাসি পরিবারের অনেক গাছে রয়েছে এ বৈশিষ্ট্যটি। এর উপপত্র রয়েছে। এগুলো খুবই ছোট, আশুপাতি বা পতনশীল।
শিলকড়ইয়ের পুষ্পমঞ্জরী বিশাল। হেডজাতীয় পুষ্পমঞ্জরীর একেকটিতে ১৬-৩০টি হলদেটে সাদা রঙের ফুল ধরে। ফুলের বৃন্ত ফিকে সবুজ, টিউবাকার, দন্তক ৫টি, অসমান। পাপড়ি আধা সেমি-এর মতো, ঘণ্টাকার, সবজেটে সাদা, খণ্ডকের সংখ্যা ৫। পুংকেশর অসংখ্য।
ফল শিমাকার, বৃন্ত বা বোঁটা একেবারেই ছোট, চ্যাপ্টা, ১০-২০ সেমি লম্বা, ১.৫-৩ সেমি প্রশস্ত, কিনারা ঢেউ-খেলানো। গাঢ় বাদামি রঙের। বীজের সংখ্যা ৭-১৩টি, বাইরে থেকে কালচে বাদামি রঙের ক্যাপসুল-ঘর গুনে তা বোঝা য়ায়। বীজগুলো ফিকে বাদমি রঙের। ফল ফেটে বীজ বেরোয় শুধু নিচের দিক থেকে। এটি শিলকড়ইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্যের একটি। ফুল ফোটে গ্রীষ্মকালে। ফল পরিণত হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। এ সময়টাতে শুকনো বাদামি ফলগুলোকে বিপুল সংখ্যায় পাতাশূন্য গাছে ঝুলতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, এর বীজ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদনক্ষম থাকতে পারে।
এশিয়ার কয়েকটি দেশে মূল্যবান কাঠের জন্য একে চাষ করা হয়। আর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কাঠপ্রদায়ী গাছের একটি এটি। এর সারকাঠ বাদামি রঙের। কাঠ বেশ শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী এবং এটি ভালো পালিশ নেয়। আসবাবপত্র বানানোতে এর জুড়ি মেলা ভার। খুঁটি, বাড়ির কাঠামো, রেললাইনের স্লিপার, কৃষি-উপকরণ, যানবাহনের চাকা, সাঁকো, ঢেঁকি তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে এর কাঠের ব্যবহার রয়েছে। সত্যিকার অর্থে গাছটির ব্যবহার-উপযোগিতা রয়েছে অনেক। জ্বালানি হিসেবে এ কাঠের ব্যবহার রয়েছে। এর পাতা গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাতির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় আমাদের দেশসহ উপমহাদেশের কোথাও কোথাও। এ দিয়ে পোকামাকড়ের বিষও তৈরি করা চলে। কাঠ থেকে ভালো কাঠকয়লাও পাওয়া যায়। কাণ্ড-নিঃসৃত কষ থেকে চমৎকার আঠা পাওয়া য়ায়। সাদা ছাল দিয়ে মাছের বিষও বানায় কোনো কোনো এলাকার লোকজন।
পাতার ক্বাথ আলসারে পুলটিস হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে আমাদের দেশে। বিষাক্ত পোকার কামড়ে এর মূলের ছাল লাগালে উপকার পাওয়া বলে কথিত আছে। গাছটিতে রয়েছে ক্যান্সারের জীবাণুনাশক উপাদান। এর মূল শুক্রনাশক। গাছের ছাল বাতের ব্যথা, পাকস্থলিশূল ও প্রসূতি জটিলতায় ব্যবহৃত হয়।
শিলকড়ই অনেকভাবে এর বংশ রক্ষার কাজটি চালায়। প্রথমত বীজের মাধ্যমে, তা ছাড়াও শিকড় থেকে এর নতুন চারা জন্মাতে পারে। আবার গাছের গোড়া কেটে দিলেও শালগাছের মতো সেখান থেকে নতুনভাবে গাছ গজিয়ে ওঠে, যাকে ইংরেজিতে বলে coppice। বেশ বিরূপ পরিবেশেও গাছটির টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। নাইট্রোজেন ফিক্সিংয়েরও ক্ষমতা রয়েছে এর।
এত এত যার গুণ, অতিরিক্ত দৈহিক বাড়বাড়ন্ত আর অন্য গাছকে দমিয়ে নিজের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ানোর প্রবণতার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাসহ দুনিয়ার কয়েকটি দেশে এর পদবী জুটেছে ভিনদেশি আগ্রাসী উদ্ভিদ বা Invasive species হিসেবে।
Comments
Post a Comment