ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

মোহাম্মদ আলি

মাঝেমধ্যে রাতে যখন ঘুম আসে না, হুটহাট করে মাথা থেকে সারা শরীরে একটা স্বপ্নময় আবেশ ছড়িয়ে পড়ে, মাথার ভেতর জ্বলজ্বল করতে থাকে : ঢাকার অদূরেই তো আছে আমাদের বিশাল বন—শালবন! শালবন! এই যন্ত্রনগরীর উপকণ্ঠেই বনের নিবিড় সবুজ সমাবেশ, মহীরুহ আকার, এর ফুলের গন্ধের অদ্ভুত মাদকতা, এর ফলের ডানা মেলে দূরে উড়ে যাওয়া, এর কাণ্ড বেয়ে ওঠা প্রকাণ্ড সব লতা, নিচে 'ভুঁইফোঁড় রঙিন পরী' শঠিফুল—রূপকথার এক বন যেন! এসব ভেবে ভেবে একসময় ঘুম চলে আসে। 

একদিন মনে হল, 'আসা-যাওয়ার পথের ধারে' যে গাছগুলো চোখে পড়ে তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, বেশ মনোযোগ দিয়ে চিনতে পারি কিনা দেখি। এই ফাঁকে নিজের উদ্ভিদজ্ঞানকেও যাচাই করা যাবে। বড় বড় গাছ, মানে বৃক্ষকে নাহয় সবই চিনলাম, ছোট ছোট উদ্ভিদ—ঘাস, গুল্ম, বীরুৎ, লতা চিনি কিনা, দেখা যাক। বুঝলাম, সব চেনা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর কাজ। অবশ্য অতিউৎসাহী হলে এইসব গাছগাছালির পরিচয় বের করা খুবই সম্ভব। নিজের বইপত্রের সংগ্রহ, ইন্টারনেট, বিশেষ করে ফেসবুকে গাছপালা সনাক্তি গ্রুপগুলোতে (বৃক্ষকথা, বাঙলার গাছগাছড়া) ছবি আর বিবরণী দিয়ে পরিচয়গুলো বের করা যেতে পারে। এতসব যখন ভাবছি, চট করে মনে হল, বৃক্ষ যদি সব চিনি, তাহলে এরা কারা? ঢাকার গাছ মানেই তো মুখস্থ সব গাছ—রেইনট্রি, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, অ্যাকাশিয়া বা সোনাঝুরি, রয়েল পাম বা বোটলপাম, কনকচূড়া বা পেল্টোফোরাম, ইপিল ইপিল, ইউক্যালিপটাস, গগনশিরীষ, বকুল, দেবদারু, নারিকেল, ফুরুস, রাধাচূড়া, টগর, বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, কদম, জীবন বা চিকন, আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, তেঁতুল ইত্যাদি ইত্যাদি। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ঢাকার গাছগাছালির তালিকার অধিকাংশ সদস্যই বিদেশি (উপরের তালিকার রেইনট্রি থেকে দেবদারু পর্যন্ত)। দেশিরাও আছে, তবে বিদেশি চাপে দিন দিন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। 

এত কথা পাড়ার মূল কারণ হল, ঢাকার ইটকাঠের জঙ্গলে আমাদের দেশের প্রাকৃত গাছগুলো তো বটেই, ঢাকার প্রাকৃত গাছই নেই! এবার তাহলে প্রশ্নটা এসেই পড়ে—ঢাকার আবার প্রাকৃত গাছ কী? আছে; ঢাকার প্রাকৃত গাছ হল শাল। কিন্তু ঢাকায় একটিও নেই। 'একটিও নেই' কথাটায় একটু অত্যুক্তি হয়ত আছে; কেননা ঢাকার উদ্ভিদ সংরক্ষণাগার মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে এক টুকরা বনের মতো করে সংরক্ষিত আছে বেশ কয়েকটি শাল। কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল বলয়ের মধ্যে (ফুলার রোডে) একটি শাল ছিল। ওটিও কাটা পড়েছে বিশালাকার দালান তোলার কারণে। তবে আশার কথা, বেশ কয়েকটি চারাগাছ ঢাকার সুদৃশ্য এলাকা হাতিরঝিলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে স্থপতি তুঘলক আজাদের বৃক্ষপ্রীতির ছত্রছায়ায়। সেগুলো মহীরুহের আকার পেলে বড় গলায় বলতে পারব আমরা—দেখো ঢাকার প্রাকৃত গাছ আছে ঢাকাতেই। 

ঢাকায় শালের মতো আরো অনেক কিছুই থাকার দরকার ছিল, যেগুলো এখন নেই। সাদা শাপলা যা কিনা আমাদের জাতীয় ফুল, ঢাকায় নেই; আছে এর ভাস্কর্য। ঢাকায় ছিল চার ধরনের ঢাক—ইসলাম খাঁর ঢাক, ঢাকেশ্বরীর ঢাক আর ছিল পলাশ আর ঢেঁকিশাক (ফার্নজাতীয়)। শেষোক্ত উদ্ভিদদুটি পরিচিত ছিল ঢাক নামে, যারা একসময় রাজত্ব করত ঢাকাজুড়ে তারা নেই। স্থানীয় সংস্কৃতিকে গিলে ঔপনিবেশিক ঢাকা এখন শুস্কং কাষ্ঠং। ঢাকা ছিল জলাভূমির শহর। শহর জুড়ে ছিল খাল, বিল, পুকুর, নালা, খানাখন্দক। এখন চারপাশ ঘিরে কেবল আছে নদীর অবশিষ্টাংশ। যেহেতু জলাভূমি নেই, লতাগুল্মের ঝোপঝাড়ও নেই। নেই এগুলোকে আশ্রয় করে পোকামাকড়, পাখপাখালি, সরীসৃপ, উভচরজাতীয় প্রাণীসহ নানা জীবজন্তু। ঢাকার পুরনো সংস্কৃতির কিছুই যেন নেই। এমনকি ঢাকার বুলি, যাকে আমরা ঢাকাইয়া ভাষা বলি, তাও ঢাকায় বিস্তৃতি পায়নি। ঢাকার একসময়কার হাতিশালের হাতিও এখন ভাস্কর্য আকারে দর্শনীয় বস্তু। একটু আগে যেমন বলেছি জাতীয় ফুল সাদা শাপলার কথা। 

এত নেই-নেই'র ভিতরেও শান্তির পরশ হিসেবে আমাদের মনে জ্বলজ্বল করতে থাকে ঢাকার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শালবন, হোক সে খণ্ডে খণ্ডে বিক্ষিপ্ত বনের আদলে, তবুও আছে। ঢাকা থেকে প্রাকৃতজনেরা উধাও হয়েছে ঠিকই, ঢাকার উত্তর আর উত্তরপূর্বে শালবন ও শাল-ভাবাপন্ন গ্রামীণ ঝোপজঙ্গলের উপস্থিতি তো রয়েছে। ঢাকার অদূরে সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর এবং সিলেটে সামান্য পরিমাণ হলেও প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শালের দেখা মিলবে। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের এর উপস্থিতি রয়েছে—আছে নেপালেও। অন্যান্য অনেক শালপ্রাংশুর (শালের মতো দীঘল গাছ) মতো শালের খুব একটা বড় ভৌগোলিক বিস্তৃতি নেই, বলাই বাহুল্য। 

শালের অন্যান্য নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। উপমহাদেশীয় মহাকাব্য 'মহাভারতে' এর উল্লেখ উজ্জ্বলভাবে থাকাতেই বোধহয় এর নামবৈচিত্র্য নেই। বৌদ্ধ 'জাতক' গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে শাল হিসেবেই। শাল গাছের নিচে মহাপ্রয়াণ হয় গৌতম বুদ্ধের। উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান দুটি ধর্মের বইতে এর নাম থাকাতে জনমনে এর নাম আদি নামটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে থাকবে তা অনুমেয়। আর শালগাছের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ার জন্য একে হেলায় ভুলে থাকাও অসম্ভবপ্রায়। আমাদের দেশের কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে টাঙ্গাইল এলাকার লোকজন একে ডাকে গজারি নামে। ছোটবেলায় আমরা ভাবতাম, শাল আর গজারি বুঝি আলাদা দুটি গাছ। আসলে তা নয়, দুটি গাছ একই। গাছের গোড়া কেটে ফেললে তা থেকেই অনেক অনেক চারা গজায় বলে এগুলোকে গজারি বলে। এই গজারিগুলোর কারণেই কিন্তু পরে একটি-দুটি করে পুরো এলাকায় শাল ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং একসময় তা বড় বনের রূপ নিতে পারে। এ ছাড়া ফল বা বীজের আধিক্য আর তার অভিনবত্ব তো রয়েছেই। এ প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, এখন চলুক এর গুণনামকীর্তন।

শাল আমাদের দেশের অন্যতম দর্শনীয় ও উঁচু গাছের একটি। বৃক্ষটি পত্রমোচী বা আধাপত্রমোচী। লম্বায় ৩০-৪০ মিটার। কাণ্ড উন্নত, ডালপালা খুব একটা বেশি হয় না। পরিণত শালগাছ প্রায় ২৫ মিটার পর্যন্ত ডালপালাহীন থাকে। কাণ্ডের পরিধি বা বেড় হতে পারে ৩.৫ মিটার। শুধু লম্বা বা বেড়ে নয়, এর চাঁদোয়াও বেশ বড় ছড়ানো। শালের নতুন ডালপালা আর পুষ্পমঞ্জরীদণ্ড ধূসরাভ, মিহি রোমে আবৃত। তবে পুরনো গাছের কাণ্ড গাঢ় ধূসর থেকে গাঢ় বাদামি, ফাটা-ফাটা। এর নতুন পাতার রূপের প্রশস্তির জন্য আলাদা লেখার প্রয়োজন রয়েছে। ফাল্গুন-চৈত্রে লালচে বা তামাটে রঙের নতুন পাতা, বিশেষ করে পুরনো গাছের গোড়ায় গজানো চারার নতুন পাতা অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেমের বীজ বুনে দিতে পারে যে-কারোর মনে। পরিণত পাতা গাঢ় ও চকচকে সবুজ থেকে হলদেটে; ১২-৩০ সেমি লম্বা ও ৮-১৫ সেমি চওড়া, ডিম্ব-আয়তাকার, আগার দিকে আকস্মিক চোখা, গোড়ার দিকে গোলাকার কিংবা কিছুটা হৃদয়াকার। পাতা চামড়াবৎ, মানে কিছুটা পুরু। শুকনা পাতা সহজে ভাঙতে চায় না। পাতাগুলো ডালে থাকে একান্তরবিন্যাসে, বোঁটা ২.৫ সেমি। শালের উপপত্র আছে, দৈর্ঘ্যে ১ সেন্টিমিটারের মতো, রোমশ।

শাল পাতা ঝরায় বসন্তের মাঝামাঝিতে। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে হলুদ-লাল পাতাগুলো গাছ থাকতে দেখা যায়। পাতা আসার সাথে সাথে আসে কাক্ষিক কিংবা শীর্ষস্থ মঞ্জরীতে হলদেটে সাদা রঙের অজস্র ফুল। শালবন তখন সুগন্ধে মৌ মৌ করতে থাকে। নিচে ঝরা পাতা আর গাছের ফুলের উৎসব নির্জন বনচারীকে স্বর্গসুখের অনুভূতির দিতে পারে। শাখায়িত পুষ্পমঞ্জরী ১২-১৩ সেমি লম্বা। ফুলগুলো পাপড়িসংখ্যা ৫, মোড়ানো, ১.২৫ সেমি লম্বা, পরাগকেশর কমপক্ষে ১৫টি, সেটি ৩০টি পর্যন্তও হতে পারে। উভলিঙ্গ ফুলগুলোতে মৌমাছিসহ বিভিন্ন ধরনের মধুকরের আনাগোনা বেড়ে যায় তখন। একসময় এ শালফুল থেকে পাওয়া মধু চাষ হতো টাঙ্গাইলের মধুপুরে। মধুপুরের নামটি নাকি শালফুলের মধুর কারণেই। 

শালের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Shorea robusta। এর ইংরেজি নাম বাংলা-নামের অনুকরণে সেই Sal-ই। এর পরিবার Dipterocarpaceae। শব্দটির অর্থ—দুই পাখাবিশিষ্ট ফল। এ পরিবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠসুন্দর গাছ গর্জন, যেটি আমাদের পাহাড়ি বনের গাছ; তার ফলের ২টি পাখা থাকলেও আমাদের শালের পাখা কিন্তু ৫টি। এই পাঁচটি পাখা দিয়ে ঘুরে ঘুরে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে শালফল। ফল প্রায় ১.২৫ সেমি লম্বা। তবে পাখাসহ এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৭-৮ সেমি। ফলের মাথা গোলগাল, গোড়ার দিকে সরু। শুকিয়ে যাওয়া ফল গাঢ় বাদামি, ১০-২০টি অসমান শিরায় চিত্রিত। কাঁচা অবস্থায় লালচে সবুজ রঙের। জুলাই মাসের মধ্যে এর ফল পরিণত হয়। গাছজুড়ে অসংখ্য ফলের উপস্থিতি তখন দারুণ এক দৃশ্যের সূচনা করে। এই দৃশ্য দেখলে যে-কারোরই মনে হবে যে, একটি ফুলও বোধহয় বৃথা যায়নি ফলে রূপান্তরিত হতে। শালের বংশবৃদ্ধির কাজটি চলে বীজের মাধ্যমে। আর গাছের গোড়ায় গজানো 'গজারি' দিয়ে তো চলেই।

এবার শালবনের কথায় আসা যাক। মোহনীয় এ বনে আমরা কে না ঘুরতে গেছি, বনভোজন-আনন্দভ্রমণ করেছি! বাংলাদেশে শালবন রয়েছে প্রায় ১২১০০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে, যা দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৩২ ভাগ। এ বন একসময় ভারতের ডুয়ার্স থেকে মেঘালয়ের গারো পাহাড় হয়ে, পুরো বরেন্দ্র এলাকা হয়ে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য বলছে, লালমাটিযুক্ত শালবনের উৎপত্তি হয়েছে প্লিয়োস্টিন যুগের ভূমিকম্পে, যা কিনা প্রায় ২ লক্ষ বছর আগের ঘটনা। ভাওয়ালগড় থেকে মানুষের ক্রমবর্ধমান বসতির ফলে কুমিল্লার ময়নামতি অঞ্চলের শালবন একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের ২৮০০ বর্গমাইলের অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলে নষ্ট হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা ও পরবর্তী সময়ে অরাজক পরিস্থিতি ও লুটপাটের হাতে পড়ে ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, নেত্রকোনার দুর্গাপুর এবং কুমিল্লার ময়নামতি পর্যন্ত শালবন এখন কোনোমতে ছত্রে ছত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বন নিয়ে ধুঁকছে। ঐ যে বলা হল, একসময়কার ভাওয়ালগড় থেকে কুমিল্লার ময়নামতি পর্যন্ত যে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন শালবন ছিল, তার স্মারক তো ঢাকা মহানগরীতে নেই। মহানগরের পার্শ্ববর্তী গাজীপুরের শালবনগুলোর অবস্থা এতটাই করুণ যে তা আর বলার নয়। এরশাদের লুটপাটের আমল থেকে দলীয় কর্মী ও স্থানীয় দুরাত্মাদের সাথে বন বিভাগের নষ্ট কর্মীদের হাতে পড়ে দিন দিন শালবনের পরিধি কমে আসছে। অহরহ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বন উজাড় হচ্ছে। প্রতি বছর একবার-দুবারের শালবন অভিযানে টের পাই, দিন দিন এ-বন, ও-বনের পরিধি কমে যাচ্ছে। ৬ বছর আগে দেখা দুর্ভেদ্য শালবনকে দেখেছি ছোট হতে হতে সংরক্ষিত জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে—টুকরা টুকরা কিছু অবস্থানে। তা ছাড়া সরকারি উদ্যোগে দেয়া লিজ-ব্যবস্থা ও কলকারখানা, বিনোদন কেন্দ্র আর বসতবাড়ি-কৃষিজমির আগ্রাসনের কারণেও বন উজাড় হচ্ছে। আরো আছে, বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ার এ আশঙ্কা থেকে সরকারি উদ্যোগেই বিভিন্ন শালবনে একসময়ে লাগানো হয়েছিল ইউক্যালিপটাস, মিনজিরি, একাশিয়া, ইপিল ইপিলের মতো ভিনদেশি গাছ। দ্রুতবর্ধনশীলতা ও মাটির ক্ষয় রোধের জন্য লাগানো হলেও এ গাছগুলো আসলে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় আর ফুল-ফলে কামড় বসাতে পারে না আমাদের পোকামাকড়, মধুকর ও পাখিসহ বিভিন্ন প্রকার জীবজন্তু। যদিও ইদানীং বন বিভাগের টনক নড়েছে। তারা শাল ও শালভাবাপন্ন গাছই লাগাচ্ছেন কোথাও কোথাও। 

প্রাণসম্পদ রক্ষার জন্য বনভূমির প্রয়োজন মোট দেশভূমির শতকরা ২৫ ভাগ। আমাদের রয়েছে ১০ ভাগেরও নিচে। স্থানীয় জনগণ ও সুশীল সমাজ থেকে উদ্যোগ না নিলে অচিরেই ঢাকার মতোই অবস্থা হবে গাজীপুর, মধুপুরসহ দেশের সবগুলো শালবনের। 

শাল সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ প্রাচীর। ঠিক কী কারণে শালগাছের এমন নাম জানা যায় না, তবে শালবনে শালের আধিক্য থাকায় সেটি দুর্ভেদ্য বনে রূপ নেয় বলেই হয়তো এমন নাম। এর কাঠের অনমনীয়তা, পুরুত্ব ও দীর্ঘস্থায়ী গুণের জন্যও এমন নাম হতে পারে।

শালগাছ শালবনের প্রধান অধিকারী। শালবনভূমির শতকরা ৯৬ ভাগই দখল করে থাকে শাল। এ বনে শাল ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় আরও প্রায় ৫০০ প্রজাতির গাছপালা। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো রয়েছে কুম্ভী, পিতরাজ বা রয়না, হলদু, সোনালু, পলাশ, ত্রিফলার ৩টিই—আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, কুসুম, বন নীল, শঠি, শালপানি, কাঞ্চনলতা, পুতিজাম, পলাশলতা, শিলকড়ই, বাজনা, শিয়াকুল, বৈঁচি, শতমূলী, গান্ধিগজারি, আসরগোটা, গজপিপুল, কুমারীলতা, মেটে আলু, কেও, ভাঁট, মটকিলা বা দাঁতমাজন, বড়বেত শালপানি, জিগা, কেউ, ভাঁট, কাকঝিঙ্গা, লুটকি বা দাঁতরাঙ্গা, মনকাঁটা, সবরজ্বালা, বিছুটি, দণ্ডকলস ইত্যাদি।

এবার চলুক শালের গুণকীর্তন। শালকাঠ লালচে বাদামি রঙের; দারুণ শক্ত, ভারী এবং টেকসই—পোকায় ধরে না। কাঠ দিয়ে কড়িবর্গা, বৈদ্যুতিক তারের খুঁটি, রেলওয়ে স্লিপার, সেতু, গাড়ির চাকা, বাস-ট্রাকের বডি, নৌকার মাস্তুল, দাঁড়, বর্শা, তাঁবুর খুঁটি, চেয়ার-টেবিল, ইটের ব্লকও তৈরি করা যায়। আর তৈরি করা যায় বাঙালি পুলিশের হাতে সেই বিখ্যাত গজারি লাঠি! শালের ডালপালা ও ঝরা পাতা উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

জ্বালানিসংক্রান্ত এ তথ্য দিতে গিয়ে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায় আশঙ্কার উৎপাতে। গাজীপুরের এক শালবনমধ্যে একরাত থাকতে গিয়ে শুনি, কে বা কারা যেন প্রতি বছর ফাল্গুনচৈত্রদাহের সময়টাতে বনের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে এমনও হয়, খণ্ডে খণ্ডে টিকে থাকা বনগুলো পুড়তে থাকে ভয়ানকভাবে। এটা নাকি স্থানীয়দের দুইশ-আড়াইশ বছরের সংস্কৃতি। জ্বালানি হিসেবে ডালপালা যোগাড় করার জন্য তাদের এ ব্যবস্থা, যেহেতু শালের ডালপালা দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলে। যে-কারণে শালবনগুলোতে উঁচু শালগাছের দেখা মেলে না মোটেও। শালবন-অভিজ্ঞ একজনের মুখে তাি শুনি : এগুলোকে লোকে বলে গজারি বন। কেননা আসল শালগাছ দুর্বৃত্তরা কেটে ফেলেছে সেই কবে। কাটা গাছের গোড়া থেকে যেহেতু গাছগুলো উঠেছে তাই এগুলো গজারি, শাল নয়। স্থানীয়রা শুধু যে ডালপালা পোড়ায়, তা-ই নয়, বনতলে পড়ে থাকা পাতাগুলোও তারা কুড়িয়ে নিয়ে যায় প্রতিদিন। হাতেনাতেই প্রমাণ পেয়েছি বনের মধ্যে দু-তিন ঘণ্টাকাল অবস্থান করেই। শালবনে দীর্ঘকায় শালগাছ নেই, নেই বনতলে আদিবনের মতো ফুটের ফুট উচ্চতার পাতার স্তূপ। আছে—আগুন লাগিয়ে বন ধ্বংস, পাতাহীন অনুর্বর, শুষ্ক-নাঙ্গা বনতল; যে-কারণে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে দিনের পর দিন। তাই 'বনে ফাগুন মনে আগুন' নয়, বলতে হয় : বনে আগুন, মনেও আগুন!

মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে শাল খুবই উপকারী গাছ। আগেকার দিনে শালের শুকনা পাতায় খাবার বিতরণ করা হত। দোকানের টুকটাক জিনিসপত্র বহনের ঠোঙ্গা বা প্যাকেট হিসেবেও ব্যবহার করা হত শালপাতা। পলিথিন ও টিসুব্যাগ বাদ দিয়ে পরিবেশবান্ধব এই শালপাতা আমরা চাইলেই ব্যবহার করতে পারি প্যাকেটের বিকল্প হিসেবে। চুরুট হিসেবেও এর পাতার ব্যবহার রয়েছে। শালের অন্যান্য অংশও বেশ কাজের। শালফুলজাত মধুর কথা আগেই বলা হয়েছে। এর বাকলে ট্যানিন আছে। ফলের বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়। এর মোথাসহ অন্যান্য অংশ দিয়ে কাঠকয়লা বানানো যায়। শালগাছের আঠাকে বলে ধুনা। এই ধুনা থেকে তৈরি সুগন্ধি ধোঁয়া জীবাণুনাশক। 

অনেককাল আগে থেকে ঔষধি হিসেবে শালের গুণগান প্রচলিত রয়েছে উপমহাদেশে। শালপাতা মেদ বাড়া, প্রমেহ রোগ, রক্তবমি ও কৃমিতে ব্যবহৃত হয়। শালের থেঁতলানো ক্বাথ মেয়েদের জননেন্দ্রিয়ের বিশেষ রোগে ব্যবহৃত হয়। আঠা বা ধুনার চূর্ণ পানির সাথে খেলে রক্ত আমাশয়ে উপকার পাওয়া যায় বলে বৈদ্যকদের পুথি-পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে। শালকাঠের সারাংশ কানের পুঁজেও ব্যবহৃত হয়। কচি পাতা ফোঁড়া ও কুঁচকি ফোলাতে ব্যবহৃত হয়। পাতাসেদ্ধ পানিতে চুলকানি সারে বলে এক সূত্র থেকে জানা যায়। 

শালবৃক্ষ নিঃশাখ, লম্বা ও উন্নত। দেখতে যে সুন্দর এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পথপাশে লাগানোর জন্য এটি হতে পারে অন্যতম শীর্ষবাছাই। অথচ আমাদের দেশে পথতরু হিসেবে এর ব্যবহার একেবারেই চোখে পড়ে না। আশা করছি আমাদের বন বিভাগসহ দায়িত্বশীল মহল অচিরেই এই কাজটি করবে। কৃত্রিমভাবে হলেও শালগাছ লাগিয়ে ঢাকার হারানো অতীতকে ফিরিয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতসাহিত্যে সালের ভুরিভুরি উল্লেখ রয়েছে। অদূরে নিবিড় শালবন, ফাঁকে-বাঁকে ধানক্ষেত আর এর মাঝে রাখালের গরু চরানো—এ এক স্বর্গকল্প। বাঙালিমহীরুহ রবি এ দৃশ্য দেখেই হয়ত একদিন গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিলেন : 'ধানের ক্ষেতের পারে/ শালের ছায়ার ধারে/ বাঁশির সুরেতে সুদূর দুরেতে/ চলেছো হৃদয় মেলে—ওগো সাঁওতালি ছেলে।' শালবন আমার কাছে 'ওগো সাঁওতালি ছেলে'। শুধু এ-ই নয়, রবির আছে আরও গান, যেমন—'শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ'।

সবশেষে একটা স্বপ্নের কথা বলি। বিপুল-বিশাল হারানো সেই শালবন তো আর পাব না, সারি সারি শাল পেতে সমস্যা কী! আহা, শাল দিয়ে যদি ঢাকার কোনো একটা প্রশস্ত ও লম্বা রাস্তার দুদিক আচ্ছাদিত থাকত—দোষের কী এমন হত! হাজার হোক, শাল তো একসময় ঢাকারই ছিল প্রাকৃত বৃক্ষ।

Comments

Popular posts from this blog

লাল সোনাইল, Java cassia, Cassia javanica

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

শিলকড়ই, Albizia procera