সুপারি, Areca catechu

সুপারি : ক্ষীণদেহী সুন্দর জীবন

কাঁচা সুপারি খেলে মাথা ঘোরে। আর এই গল্পটি শুনলে যে-কারোরই তা দমকে দমকে ঘুরবে। তো শোনা যাক সেটি। এক কৃষক ভাবলেন পান তো খাই-ই, তো সেটা কিনে খেতে হবে কেন, পানগাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। বুদ্ধিমান কৃষক তার বাড়ির সামনের ফলবান সুপারি গাছের গোড়ায় পানলতা লাগিয়ে দিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে লতা বড়ও হল। এদিকে এক পথিক ক্লান্ত হয়ে ও বাড়ির পাশে থামলেন বিশ্রাম নিতে। সুপারি গাছে পানলতা দেখে তার পান খাওয়ার নেশা দারুণভাবে চেপে বসল। কয়েকটা সুপারি পেড়ে পানপাতায় হাত দিতে গিয়ে ভিমড়ি খেলেন তিনি। অবাক হয়ে দেখেন, আরে! পানে তো চূন লেগে আছে! অতিথি-সৎকারের এমন অপূর্ব-অশ্রুত কায়দা দেখে ঐ বাড়ির লোকজনকে অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ দিতে দিতে, মুখে পানসুপারিচূন পুরে, পথে যেতে যেতে এক মহৎ ছড়ার আবিষ্কার করে ফেললেন : একই গাছে পান সুপারি, একই গাছে চুন, এদেশের মাটির ভাই কী সুন্দর গুণ! 


আসলে গল্পটি একটা ধাঁধাকে কেন্দ্র করে রচিত। প্রশ্ন হল, পান সুপারি নাহয় বোঝা গেল সে কৃষকের লাগানো, তৃতীয় উপাদানটা তাহলে কোত্থেকে হাজির হল? এর উত্তর হল, পাখির বিষ্ঠা। 

সুপারি নিয়ে আমাদের লোকসাহিত্যে অনেক কিসসাকাহিনি, লোকছড়া, প্রবাদ-প্রবচন রচিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। জনপ্রিয় কবিসাহিত্যিকরাও বাদ যাননি; সুপারি নিয়ে তাঁদের অভিব্যক্তি যায় যার মতো করে দিয়ে গেছেন। সংস্কৃতসাহিত্য ও প্রাচীন ঔষধশাস্ত্র এর উল্লেখ রয়েছে উজ্জ্বলভাবে। উপমহাদেশের সনাতন ধর্মীয় লোকাচারেও এর উপস্থিতি দারুণভাবে রয়েছে, আর বাঙালিসংস্কৃতিতে তো বটেই।

এবার আনুষ্ঠানিক পরিচিতি দেয়া যাক। সুপারির ফল জনপ্রিয় খাদ্য পানের সহযোগী। বাঙালিদের কাছে সুপারি, তামাকপাতা, নানারকম মসলা, চুন ও খয়ের যোগে পান খাওয়ার চল রয়েছে সেই সুদূরকাল থেকে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। গ্রামের পাশাপাশি শহরের অনেক মানুষ এর দারুণ ভক্ত।

সুপারিকে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় দেশজুড়ে, বিশেষ করে দেশের সমুদ্রোপকূলবর্তী জেলাগুলোতে। এ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার ঘরপ্রাঙ্গণে আম, কাঁঠাল, নারিকেলের সাথে এর আদুরে ঠাঁই হয়। বসতবাড়িতে রোপিত সাধারণ গাছের একটি এটি। দক্ষিণাঞ্চলের অনেক বাড়ির পিছনে আস্ত বাগানই রয়েছে সুপারির।

গাছটি যেহেতু এরিকাসি (Arecaceae) পরিবারের, যার সদস্যসংখ্যা প্রায় ২৬০০, এদের অধিকাংশই দেখতে বেশ সুন্দর এবং এরা সারা পৃথিবীতে বাহারি বা আলঙ্করিক বৃক্ষ হিসেবে বসতবাড়ি, ব্যক্তিগত বাগান, উদ্যান, কার্যালয়প্রাঙ্গণ ও পথপাশে রোপিতি হয়ে থাকে; যেমন, তাল, খেজুর, রয়েল পাম,  ফক্সটেইল পাম, এরিকা পাম, চায়না পাম, সেন্ট্রি পাম ইত্যাদি। সুপারির কাণ্ড অন্যান্য পামের মতোই অশাখ, সরল, উন্নত, দীঘল। এর মাথায় রয়েছে ছড়ানো পাতার গোলগাল চাঁদোয়ার উপস্থিতি। পাম-পরিবারের আরেকটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটি তার ফলের প্রাচুর্য। শুধু প্রাচুর্যই নয়, এদের ফলে রয়েছে উজ্জ্বলতার দীপ্তি। সুপারির পাতার ডানার কোলে ধরা অঢেল হলুদ কিংবা কমলাটে লালের ঔজ্জ্বল্য বাঙালিজীবনের এক অমোচনীয় স্মৃতি। 

গাছটির কাণ্ড ছিপছিপে, চিকন কিন্তু খাড়া, বেড়ও কম অন্যান্য পাম-পরিবারের গাছের চেয়ে, মাত্র ৩৫ সেমি; বাকলের রঙ ধূসর। উচ্চতা পায় ২০-২৫ মিটার। চারাগাছ দেখতে পরিণত গাছের চেয়ে সুন্দর। বয়স্ক গাছের কাণ্ড নমনীয়, পাতার ভারে মাঝে মধ্যে এদিক-ওদিক হেলে পড়ে। কিন্তু চারাগাছের কাণ্ড ঋজু ও উন্নত; পাতা ও কাণ্ড গাঢ় সবুজ রঙের। অশাখ কাণ্ডের একেবারে শেষদিকে একান্তর-বিন্যাসে গুচ্ছাকারে ভিড় করে থাকে অর্ধবৃত্তাকার পক্ষল পাতাগুলো, যে-কারণে এদের মুকুট গোলাকার। ডালের মতো দেখতে একেকটি পাতার আকার হয় ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত। ডাল-পাতায় অণুপাতার সংখ্যা ৭০-৮০; গ্রথন মজবুত, তবে অন্যান্য পাম-প্রজাতির চাইতে অবশ্য কম মজবুত, গাঢ় সবুজ রঙের, একান্তরবিন্যাসে বা ঘূর্ণিত অবস্থানে থাকে। 

ফুল আসে বসন্তে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে, অঢেল পরিমাণে। স্প্যাডিক্সজাতীয় বেশ বড় ও বহুশাখী মঞ্জরীতে দুটি নৌকামতো মঞ্জরীপত্রের নিবিড় আবরণে খুব ছোট আকারের ফুলগুলো ধরে। মঞ্জরীপত্রের কাজ হল ফুলগুলোকে প্রায় নিশ্ছিদ্র পাহারা দিয়ে লালন করা। ফুল স্বরূপে আসলে এই মঞ্জরীপত্র-দুটি খসে পড়ে। ক্ষুদ্র ফুলগুলো সাদাটে রঙের, একলিঙ্গিক, বৃন্তহীন। স্ত্রীফুলের অবস্থান মঞ্জরীর নিচের দিকে আর পুরুষগুলো অগ্রভাগে। স্ত্রীফুল একক কিংবা ২-৩টি। বৃত্যাংশ ও পাপড়িসংখ্যা ৩। পুংকেশরসংখ্যা ৬।

ফলগুলো গোলগাল, ৩.৫-৫ সেমি চওড়া, হলুদ কিংবা কমলাটে লাল, একবীজী ড্রুপ। 

বাঙালি ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের লোকেরা জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে সুপারি খেয়ে থাকে। এ ছাড়া সুপারির ব্যবহার রয়েছে পাপুয়া নিউ গিনি, মাদাগাস্কার ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সব মিলিয়ে সুপারির সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে পৃথিবীর প্রায় ৬০ কোটি লোকের। 


ভিয়েতনামের এক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা সুপারি ও পানকে ব্যবহার করে তাদের 'বিয়ে-চিহ্ন' হিসেবে। যার দাঁতে লাল রঙ বেশি ধরবে তার নাকি সে-সমাজে সম্মান তত বেড়ে যাবে। আর সাদা দাঁত নাকি থাকে জীবজন্তুর, মানুষের ওরকমটি হবে কেন! আমরা জানি, সুপারির ফলে রয়েছে ট্যানিক এসিড ও লোহার যৌগ। এগুলো লাল রঙ তৈরিতে সাহায্য করে। তাই সুপারির মিশ্রণে জিব-ঠোঁট রাঙা করে পান না খেলে বাঙালিরই-বা মন মাতবে কেন!


বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম সুপারি। সাধারণত ৬-৮ বছর বয়সে ফুল-ফল দেয়া শুরু করে। একটানা ৩০-৪০ বছর ফলন দেয়। বেশি ফলন আসে প্রথম ১০-১২ বছর থেকে। ফুল ধরার ৫-৬ মাস পরে সাধারণত ফল পাকে। প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ফল ধরে ৩০০টি। বর্ষাকালে বীজ হতে চারা পওয়া যায় সহজেই। সাধারণত লোনা পানিতেই এর বাড়বাড়ন্ত। তবে পাহাড়ি এলাকাতেও ভালো জন্মে। প্রচুর বৃষ্টিপাত আর রোদে সুপারি গাছ প্রাণ পায়। তবে জলাবদ্ধতা ও খরা, কোনোটাই সহ্য করতে পারে না গাছটি। ঝড়েও মাঝে মধ্যে ভুলুণ্ঠিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় একে। গাছটি বাঁচে ৫০-৬০ বছর।  


কাঁচা সুপারি খেলে মাথা ঘোরে, কেননা এতে রয়েছে .১-.৫% অ্যালকলয়েড। উল্লেখ্য, মানবদেহে ২৮৯ ক্যালরির যোগান দেয় প্রতি ১০০ গ্রাম সুপারি। এত যার গুণ, ড্রাগ বা মাদক হিসেবে সারা বিশ্বে তার স্থান ৪র্থ! প্রতি বছর সুপারি খাওয়ার কারণে ২০০০-২৫০০ মানুষ মুখগহ্বরের ক্যান্সারে মারা যায়। 


ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি প্রদেশে সুপারি গাছের পত্রাবরণ দিয়ে তৈরি হয় পরিবেশবান্ধব বাসনকোসন। এসব প্রদেশের কোনো কোনোটিতে বটজাতীয়, বিশেষ করে রাবার বটের শিকড়কে ব্যবহার করা হয় পাহাড়ি পথের সেতু হিসেবে। প্রথমে সুপারির কাণ্ডকে ফেঁড়ে দুভাগ করে খোদাই করে নির্মিতব্য সেতুর দুধারে রেখে তার ভিতর দিয়ে শিকড়কে বেড়ে দেওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়। কালক্রমে শিকড়ের অংশ বড় হলে তা পাকিয়ে ধীরে ধীরে নুড়িপাথর ফেলে তৈরি করা হয় একেকটি 'জীবন্ত সেতু'। 


Areca ভারতের তামিল ভাষার শব্দ, অর্থ একগুচ্ছ ফল। Catechu মালয়েশীয় নাম, সুপারিকে তারা এ নামে ডাকে।


সুপারি গাছ হতে পারে আমাদের সুন্দরদেহী পথতরুর অন্যতম। ৩ মিটার দূরত্ব রেখে সারি করে রোপণ করলে রোমাঞ্চকর দৃশ্যের সূচনা হতে পারে নগর বা শহরের যেকোনো রাস্তার দুপাশ। আমরা যারা গ্রামে যাই, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, তারা এর সারি দেখে পুলক অনুভব করি মনে। 


সুপারির ফল জীবাণুনাশক, সংকোচক, উদ্দীপক, স্নায়ুশক্তি বৃদ্ধিকারক, ক্রিমিনাশক, কামোদ্দীপক, ঋতুস্রাববর্ধক। পেটের পীড়া, আলসার, দন্তরোগ, ডায়রিয়ায় এর ব্যবহার রয়েছে। কাঁচা সুপারি মুখমণ্ডলের প্যারালাইসিস দূর করতে পারে। মূলের নির্যাস ঠোঁটের ঘা সারায়। কচি পাতা কটি-বাতে ব্যবহার করা হয়। 


সুপারির সংস্কৃত নাম গুবাক। ধারণা করা হয়, গুবাক শব্দটিই কালের বিবর্তনে গুয়া-য় এসে ঠেকেছে।


ছবি : নিজ

Comments

Popular posts from this blog

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

রসুন, Garlic, Allium sativum