নববর্ষে শঠির বিস্ময়কর উদয়

নববর্ষে শঠির বিস্ময়কর উদয়

মোহাম্মদ আলি

আচ্ছা, গরমকালে তো অনেক ফুলই ফোটে আমাদের সবুজশ্যামলসজল দেশটায়; ঠিক পহেলা বৈশাখের দিন আমরা কী কী ফুলের দেখা পাব—বলতে পারবেন কেউ? যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা ওদিন কাঞ্চনগাছে ফুল পাবই পাব। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যেমন পাব তরুণশুভ্র কাশ, রান্নায় ডালের সাথে থাকবে সুস্বাদু জলপাই। জানুয়ারির প্রথম দিন নিশ্চিত করে পাব সরিষাফুল। আবারো প্রশ্ন—পহেলা বৈশাখে তাহলে কোন ফুল পাব? আমি নিশ্চিত করেই বলছি, শঠি পাবেন এদিন। শঠি ছাড়াও অবশ্য পাবেন পানিপ্রেমী জারুল, হিজল, বরুণ আর মাঠঘাট, গ্রামশহর-কাঁপানো কয়েকটি পরিচিত গাছের ফুল। তবে শঠির কথা আলাদা। সে বনবাণী শুধু নয় ধারণ করে বাঙালিবাণী। উদয় ঘটে তার বনতলে, হঠাৎ করেই। রূপকথার এক অদ্ভুত, বর্ণিল পরি যেন সে! 

দশ-এগার বছর আগে এক জ্যেষ্ঠ বন্ধুসহ তিনজন মিলে চলে গেলাম গাজীপুরের চন্দ্রার শালবনে। নির্জনতার একটা আলাদা 'শব্দ' যে পৃথিবীতে আছে তা সেদিন ভালো করে বুঝেছি আমরা তিনজন। আমার আবার চড়কপূজা দেখবার খুব সখ হয়েছিল সেবার। কোথায় গেলে পাব চড়ক, সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ঢাকার কাছেই গাজীপুরের চন্দ্রা, চলে যান। সেখানে পাবেন আদিবাসীদের গ্রাম—কোচদের গ্রাম। ব্যস! আর কোনো কথা নেই, ঢাকার এত কাছেই 'চক্ষু চড়কগাছ' করব, শালবন পাব, তার ওপর বাঙালিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনধারা! খৈ ফোটা শুরু হয়ে গেল বুকের ভেতর। দুদিন পরই বাস থেকে নেমে, ভ্যানে চড়ে, কোকিলের পাপিয়ার মধুর ডাক শুনতে শুনতে ছোট্ট শালবন পেরিয়ে ঢুকলাম কোচদের গ্রামে। সেখানে পৌঁছে জানতে পারি, চড়কপূজা আজ নয়, আগামীকাল। আমি কোচ সম্প্রদায়ের একজনকে বললাম : কিন্তু আজ তো চৈত্রসংক্রান্তি, চড়কপূজা তো আজই হওয়ার কথা। জবাব আসল : লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসরণ করে আমরা দিনক্ষণ ধার্য করি তো। তাই আপনাদের সাথে একদিন আগেপিছে হয়ে যায় আর কি। চৈত্রদগ্ধ হয়ে, হতাশ হয়ে কোচগ্রামে চা খেয়ে, একটু জনজীবনের খোঁজখবর নিয়ে তিনজন সিদ্ধান্ত নিলাম, বেলা আর বেশি নেই, শালবনেই ঘোরা যাক তাহলে। 

এখানকার শালবনে দেখা মিলল না কোনো পরিণত শালগাছের, যেটা প্রায় গোটা গাজীপুর জেলারই ধারাবাহিকতা। তবে অসংখ্য শালের উপস্থিতি আমাদের মনের মধ্যে বনের রঙ ছড়িয়ে দিল। শালবনে শালের একচেটিয়া রাজত্ব। ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে পিতরাজ, বাজনা, আকরকণ্ট, আসরগোটা, গান্ধিগজারি, মনকাঁটা, বড় বেত, বৈঁচি, শেয়াকুল, শালপানি, জিগা, কুম্ভী, কুমারীলতা, পলাশলতা, মেটে আলুর একটা প্রজাতি, কেও, লুটকি বা দাঁতরাঙ্গা, ভাঁট, দাঁতমাজন ইত্যাদি। এ বনে শালের পরেই বেশি করে আছে বড় বেত, দাঁতরাঙ্গা আর মনকাঁটা। আর আছে, যাকে নিয়ে এত এত তালবাহানা, সেই 'ভুঁইফোঁড়' শঠি। এ এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দরের প্রদর্শনী যেন। শঠির পুষ্পমঞ্জরিদণ্ড যেন স্বর্গীয় এক দূত। গাছের কোনো চিহ্নমাত্র নেই কিন্তু বনতলে বিচিত্ররঙিন পুষ্পদণ্ডের আকস্মিক উপস্থিতি দেখে আমার মতো অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন আমি নিশ্চিত। শঠির বিশেষত্ব এখানেই।

শঠি উদ্ভিদটি দেখতে অনেকটাই হলুদ গাছের মতো। তাই শালবনে প্রথম-প্রথম যেকেউ এর উপস্থিতি দেখে তাকে হলুদই মনে করবেন হয়তো। দূর থেকে এই দুটিকে আলাদা করে চেনার একটা সহজ সূত্র আমি নিজে থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি—যদি বসতবাড়ির আশেপাশে দেখা যায় তাহলে গাছটি হতে পারে হলুদ আর পতিত জমি কিংবা বনের মধ্যে দেখা মেলে তাহলে হয়ত শঠি। কিছু আঙ্গিক পার্থক্য তো এদের মধ্যে অবশ্যই আছে, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে পরে।

শঠির কন্দজ উদ্ভিদ, মানে কিনা যা কন্দ থেকে বাড়ে। কন্দটি কিন্তু শিকড় নয়, কাণ্ডের রূপান্তরিত অংশ, যা হলুদ, আদা কিংবা কচুরমুখির মতো চারদিকে শাখা-প্রশাখা বের করে দেয়। পরিণত অবস্থায় বেশ বড়সড় আকার নেয় কন্দটি। কন্দ ফ্যাকাশে সাদা থেকে কিছুটা হলদেটে; মাঝেমধ্যে বাদামির ঝলকও দেখা যায়। কন্দের শেষপ্রান্তে অনেকসময় ডিম্বাকার ভাবও লক্ষ করা যায়। স্বাদে কিছুটা তিতা; আদার মতো কিছুটা ঝাঁঝালও। মুখে পুরে কিছুক্ষণ চিবুলে তিতকুটে ভাবটি প্রকট হয়, সাথে সাথে নয়। পাতাতেও এই তেতো ভাব আছে, যে-কারণে গরুছাগল এর পাতায় মুখ দেয় না। কন্দে গন্ধ আছে—কিছুটা কাঁচা আম, আদা আর গাজরের মিলিত গন্ধ। 'আম-আদা' নামে আমাদের আরেক কন্দজাতীয় গাছের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন। আম-আদার কন্দে রয়েছে কাঁচা আমের গন্ধ। এর দ্বিপদী নাম Curcuma amada; সহজেই আদা, রসুন, হলুদ, পেঁয়াজের মতো চাষ করা যায়। শঠির কথায় ফেরা যাক। শঠির কন্দগুলোর একেকটি হতে পারে ৫-১২ সেমি লম্বা। আগেই বলা হয়েছ,  হলুদ কিংবা আদার মতো শাখা-প্রশাখা হয় একেকটি কন্দের। 

শঠির কন্দ থেকে একসময় আমাদের দেশে তৈরি হত 'পালো' নামের খাদ্যবস্তু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক চাহিদার কারণে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এই পালো তৈরি হয়েছিল। এক সূত্র থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় তা কুটির শিল্পের মতোই স্থান পেয়েছিল। পালো তৈরির কাজটা কিছুটা আয়াসাধ্য। শঠির পরিপুষ্ট কন্দ পানিতে চটকে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হলে পাত্রের নিচের দিকে ভোরবেলায় হলদে সারাংশ থিতু হয়। পরে উপরের স্বচ্ছ পানি ফেলে আবার নতুন পানি দিয়ে চটকে রাখলে সাদা সারাংশ পানির নিচে জমা হতে থাকে। এই শ্বেতসার শুকিয়ে গেলে ময়দার মতো মিহি অংশ পাওয়া যায়। দুধ ও চিনির সাথে শঠির ময়দা রান্না করলে তা দারুণ স্বাদের হয়। আগে বাচ্চাদের এই পালো খাওয়ানো হত বার্লির বিকল্প হিসেবে। 'হাতের কাছে কোলের কাছে' যা পাই তাকেই আমরা জীবনসংগ্রামের নিত্যতায় ব্যবহার করে ফেলি—এখানেই বাঙালির প্রকৃতিনিষ্ঠতার ব্যাপারটি বোঝা যায় সরলভাবে। শঠির অনেকরকম ব্যবহার রয়েছে আমাদের দেশে, বাইরের দেশে। সে-কথায় পরে আসছি। এবার চলুক উপরাঙ্গকীর্তন।

শঠি উদ্ভিদটি দেখতে অনেকটাই হলুদের মতো, সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। ১ মিটারের চেয়ে খুব একটা বেশি বাড়ে না শঠি।

উদ্ভিদটি বীরুৎশ্রেণির হলেও ঝোপালো গড়নের। গুল্ম হওয়ার জন্য কাণ্ডের যে ঋজুতা ও কাষ্ঠল ভাবটি দরকার, তা নেই। রোমহীন পাতাগুলো বিশাল আকারের। ২০-৬০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। প্রশস্ততায় হয় ৯-১৫ সেমি। এগুলো আয়তকার বা আয়ত-বর্শাফলাকার। পাতার বোঁটা ১২-২৫ সেমি লম্বা হয়। পাতার গোড়ার দিকটা সংকীর্ণ, আগা চোখা। শঠির পাতার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে—এর মধ্যশিরা-বরাবর চওড়া বেগুনি বা লালচে রঙের দাগ থাকে; যেরকমটি অনেক সময় কলাবতীর পাতায় দেখা যায়। শঠির পাতার সংখ্যা ৪-৬। অথচ শালবনতলে একসাথে অনেকগুলো শঠি কলোনির মতো থাকে বলে দূর থেকে সবুজের একটা দারুণ আভার জন্ম হয়। শালবন ছাড়াও বননন্দন উদ্ভিদটি আমাদের পার্বত্য এলাকার পাহাড়ের ঢালে, বনভূমির ধারে, গ্রামের ঝোপঝাড়ে এখনও পর্যাপ্ত সংখ্যায় রয়েছে। 

শঠির ফুলসৌন্দর্যের প্রশস্তি আছে জীবনানন্দের বিভিন্ন কবিতার শরীরে : 'ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে/ মধুকর ডিঙ্গা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/ এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ/ দেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে—'। আরো কয়েকটি কবিতায় শঠির প্রসঙ্গ এনেছেন কবি। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যেও উল্লেখ রয়েছে উদ্ভিদটির। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলার সাহিত্যিকদের কবিতা, গান, গল্পে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস বা রেখাপাত আমাদের চোখে ধরা দেয় না। 

আগেই বলা হয়েছে, শঠির পুষ্পমঞ্জরীদণ্ড মাটির নিচ থেকে জেগে ওঠে এর কোনরকম পাতা গজাবার আগেই। চৈত্র-বৈশাখ মাসের কোনো একটা সময় শালবনে ঘুরতে গেলে এই অদ্ভুতসুন্দর প্রস্ফুটন চোখে পড়বে। উদ্ভিদটি মূলত বহুবর্ষজীবী। প্রতি বছর ফুল-ফল দেয়া শেষে পাতা শুকিয়ে গাছটি শুকিয়ে মরে গেলেও মাটির নিচে এর প্রাণভোমরা কন্দটি একটু 'শীতনিদ্রা'য় যায়। পরের বছর সময়-সুযোগমতো জেগে ওঠে এর বিস্ময়কর, ঝলমলে রঙিন মঞ্জরীদণ্ড। এর মাধ্যমে সে যেন শুভেচ্ছা জানায় বাংলা নববর্ষকে। ১৫-২০ সেমি দৈর্ঘ্যের পুষ্পদণ্ডটির নিচের দিকে কচি সবুজ, উপরের দিকটা বর্ণালি। লালচে, লালচে বেগুনি, সাদাটে বেগুনি, সাদাটে সবুজ—এরকম বিচিত্র রঙের কোলে ধরে এর ছোট ছোট কলসির মুখের মতো মুখ পেতে থাকা হলদে রঙের একেকটি ফুল। রঙিনসুন্দর অংশগুলোই কিন্তু এর উপপত্র। একেকটি মঞ্জরীদণ্ডে উর্বর ও সাদাটে সবুজ রঙের উপপত্রের সংখ্যা হতে পারে ১৫-৩৩। এগুলো  ৩-৫ সেমি লম্বা, ৩-৪ সেমি চওড়া। আগার দিকটা গোলাকার বা ভোঁতা। উপরের দিককার উপপত্রগুলো লালচে, লালচে বেগুনি, বেগুনি অথবা মৃদু বেগুনি, সংখ্যায় ৭-১৪। একেকটি মঞ্জরীতে ৬-৭টি ফুল থাকে। ফুলগুলো উপপত্র থেকে কিছুটা সামনের দিকে বেরিয়ে থাকে। মধুকরকে আকৃষ্ট করার চমৎকার উদাহরণ এর ফুলগুলো। বৃতি টিউবযুক্ত, সাধারণত তিন খণ্ডক, দলমণ্ডলও টিউবযুক্ত, প্রায় ৩ সেমি লম্বা, পাপড়ি ৩টি, হলদে রঙের।

শঠির ফল সাধারণত দেখা যায় না। কন্দের মাধ্যমে যে সহজেই বংশ বিস্তার করতে পারে, তার অন্যদিকে মনোযোগ দেবার সময় কোথায়। এর ফুল ফোটে গ্রীষ্মে, এপ্রিল-মে মাসে—কাঠফাটা-মাটিফাটা গরমে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, শঠির জ্ঞাতিগোষ্ঠী হলুদের ফুল ফোটে আগস্ট থেকে অক্টোবরে, বর্ষার শেষের দিকটায়। তাহলে ফুলের মৌসুমভিন্নতার কারণে হলুদ আর শঠির ফুলকে আলাদা করে চেনাটা আমাদের জন্য একেবারে সহজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শঠির বীজকোষ ডিম্বাকৃতি, মসৃণ। বীজ সাদা ও লম্বাটে। 

আমাদের দেশের অনেকখানেই শঠির দেখা মিলবে। তবে এখনো ফসল হিসেবে আমাদের দেশের কোথাও এর চাষ হয় কিনা জানা নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে এর চাষের খবর পাওয়া যায়। আগেকার দিনে শঠির পাতা দিয়ে গরিবঘরের থালা বানানো হত। কিছুদিন আগেও বাংলার হাটবাজারগুলোতে লবণ ও গুড় বেঁধে বিক্রি হত শঠিপাতায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর দেখা মিলবে। তবে এর খাদ্যগুণ, ঔষধিগুণ কিংবা গাছ বা ফুলের প্রসিদ্ধির জন্যই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক, এটা দুনিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেছে বিস্তরভাবে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ সময়কালে অস্ট্রেলেশিয়ান জনগোষ্ঠী প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা থেকে মাদাগাস্কার পর্যন্ত একে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত বলে সূত্রগুলো জানাচ্ছে। 

উপমহাদেশীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে শঠির অনেক গুণের কথা বলা হয়েছে। শঠির কন্দ উত্তেজক, প্রস্রাবকারক, উষ্ণ ও পাচকগুণবিশিষ্ট। ঔষধ হিসেবে মূলত ব্যবহার করা হয় এর কন্দ ও কন্দজাত শ্বেতসারকে। বমি, পিপাসা, গা-গরম ও মাথা ধরায় শঠিচূর্ণ গরম পানিতে ২-৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। বাচ্চাদের কৃমির উৎপাতে পেট ফুলে গেলে এ পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ফোঁড়া, প্লীহার বৃদ্ধি, অতিসারেও শঠির শ্বেতসার বেশ কাজের। মিছরি ও মরিচের গুঁড়া শঠিকন্দের সাথে মিশিয়ে খেলে শ্বাসকষ্ট ও কাশির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তা ছাড়া ক্ষত, সন্তান প্রসবজনিত দৌর্বল্যে কন্দ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে বাংলার বিভিন্ন জায়গায়। শঠিকন্দের এক টুকরা মুখে রেখে আস্তে আস্তে চিবুলে কাশি বন্ধ ও কফ নিঃসরিত হয় বলে ভেষজ চিকিৎসকরা তা প্রয়োগ করে থাকেন। কিছুকাল আগেও গায়ক-গায়িকারা গলা পরিষ্কার রাখা বা গলার উসখুস ভাব কাটাবার জন্য শঠির কন্দ মুখে পুরে চিবুতেন। পাতা-বাঁটা গা-ফোলা রোগে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে আমাদের দেশের কোথাও কোথাও। পটুয়াখালীতে শঠির ময়দা পিঠা বানানোতে ব্যবহৃত হয়। 

আমাদের দেশে শঠি এখনো বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে; তার প্রমাণ এর ভুরিভুরি আঞ্চলিক নামের প্রাপ্তি দেখে। ফইল্লা, খইল্লা, হডি, হুইট, ফুইট, গোয়াদা, ঘিকমা ছাড়াও কোথাও কোথাও বনহলুদ, বার্লিগাছ বলেও ডাকা হয়। সংস্কৃতে একে বলে সুভদ্রা, সৌম্যা, পলাশিকা, সুগন্ধমূলা ইত্যাদি। এ ছাড়াও মারমা, চাকমা ও তঞ্চঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা একে আলাদা আলাদা নামে একে চেনে। এর ইংরেজি নাম Zedoary, White turmeric। দ্বিপদী নাম Curcuma zedoaria, পরিবার Zingiberaceae।

সবশেষে একটা কথা বলা জরুরি হয়ে পড়েছে : আমরা যারা বাগান করি তারা তো মূলত ফুলের বা ফলের কথা বিবেচনা করেই তা করি। তাহলে শঠিকে আমরা তা থেকে বাদ দেব কেন—এত সুন্দর যার ফুল, এত আকস্মিক যার ফুলের ভুঁইফোড়-আবির্ভাব, তাকে বাগানে স্থান দিলে তো বাগানের মর্যাদাই বাড়বে। পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর সময়টাতে সবাইকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারবেন : ঐ দেখ, নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতে শঠি জেগে উঠেছে পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানাতে। 

শালবন আর শঠিকে আমার কাছে মনে হয় হরিহর। শালবন যেমন মনের মধ্যে ঘোর তৈরি করে রাখে মাঝে মধ্যে, শঠির ফুলও তেমনি বৈশাখী সুবাতাস এনে দেয় আমার মতো পোড়া নগর-নাগরকে। মনের মধ্যে নাহয় থাকল শঠিফুল সারা বছর, বনে তো আর তার থাকার সে সুযোগ নেই; প্রকৃতির নিয়মে 'প্রখরতপনতাপে' চৈত্রদিনের শেষে মাটি ফুঁড়ে তাকে জেগে উঠতেই হয়। আর তার জেগে ওঠা মানেই নতুনকে আহ্বান করার খবর ছড়িয়ে দেয়া। মন বলে : পহেলা বৈশাখে বনতলের এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা শঠিরা যেন একযোগে তখন আওয়াজ তুলে বলে—শুভ নববর্ষ!

Comments

Popular posts from this blog

লাল সোনাইল, Java cassia, Cassia javanica

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

শিলকড়ই, Albizia procera