আমাদের ঘেঁটকচু

আমাদের ঘেঁটকচু

মোহাম্মদ আলি

দেশের এখানে সেখানে, পথে-ঘাটে, ঘাসের দঙ্গলে, অন্যান্য তৃণ-বীরুতের সাথে স্যাঁতসেঁতে কি ভেজা জায়গায় ঘেঁটকচুকে জন্মাতে দেখা যায়। আমাদের দেশের অন্যতম সবজি কচুর মতো অতটা জনপ্রিয় না হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন মাঠঘাট থেকে এর পাতা, ডাঁটা ও কন্দ যোগাড় করে খেয়ে থাকে। আমি নিজে দেখেছি, ঢাকার নবাবগঞ্জ ও নেত্রকোনার মদনে এর কচি পাতা নারীরা সংগ্রহ করছেন খাওয়ার জন্য। অযত্নসম্ভূত এ নরম বীরুৎটিকে আমাদের দেশে তেমন একটা চাষ করতে দেখা যায় না গেলেও হাটে-বাজারে মাঝে মধ্যে এর দেখা মেলে। দক্ষিণ ভারতে এর কিছুটা চাষ হয় বলে জানা গেছে।

ঘেঁটকচুর কচি পাতা ভেজে তার সাথে মরিচ, লবণ ও কালোজিরা দিয়ে বৃহৎ বাংলার কোথাও কোথাও খাওয়া হয়ে থাকে। এর ডাঁটা ঘণ্ট বা ঘেঁট করে খাওয়া হয় বলে এর নাম ঘেঁটকচু হতে পারে বলে এক সূত্র অনুমান করছে। বাঙালমুলুকে বীরুৎটির কয়েকটি আঞ্চলিক নাম রয়েছে; যেমন—ঘেটকোল, ঘাটকোল, খারকোল, খারকেলি, ঘেকুল, খারকুন। বগুড়ায় একে বলে চামঘাস। এটি যে আমাদের সমতল ছাড়া পাহাড়ি বনাঞ্চলেও পাওয়া যায় তার স্মারক হিসেবে রয়েছে আরও কয়েকটি আঞ্চলিক নাম; যেমন—হরবাজ বলে চাকমা সম্প্রদায়, মোহরা বলে মারমারা, হরবাইত বলে তঞ্চঙ্গ্যারা। 

ঘেঁটকচু দেখতে বেশ সুন্দর—বিশেষ করে এর পাতার রূপ দেখার মতো। এর পাতা অবশ্য বিভিন্ন রকমের—তির-ফলকের আকার  থেকে শুরু করে ৩টি সুস্পষ্ট লতিযুক্ত হতে পারে; দূর থেকে এ কারণে আলাদা তিনটি পাতা বলে মনে হয়। গোড়ার দিকে অসমানভাবে হৃদপিণ্ডাকার, আগার দিকে সামান্য চোখা। অবশ্য মাঝে মধ্যে ৫টি খণ্ডকেরও দেখা মিলতে পারে, তবে তা বিরল। কচু গোত্রের অন্যান্য সদস্যের মতো এরও পাতার সংখ্যা কম, বড়জোর ৫ থেকে ৬। পাতার বৃন্ত বেশ লম্বা, ২৫-৪০ সেমি পর্যন্ত, রঙ সবুজ, তবে মাঝেমধ্যে লালচে-বেগুনিও হয়। পাতার একেকটি খণ্ডক ২০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। 

ফুল ধরে কচু গোত্রের বৈশিষ্ট্যধারী স্প্যাডিক্স মঞ্জরিতে। মজার ব্যাপার হল, কন্দ থেকে উদ্ভিদটি মাটি ফুঁড়ে বেরোবার আগেই এর ফুলের উদয় হয়—ঠিক যেমনটি আমাদের শঠি করে থাকে বাংলা নববর্ষের ঠিক আগে-পরের সময়টাতে। স্প্যাডিক্স মঞ্জরিতে ফুল ধরে। মঞ্জরি-ঢাকনা বা spathe স্প্যাডিক্সকে ছাড়িয়ে যায়। এটি ডিম্বাকার অথবা গোলাকার, ১৫-১৮ সেমি লম্বা। ভেতরের দিকটা মেরুণ অথবা গাঢ় লালচে-বেগুনি, পাপড়ির বাইরের দিকটা সবুজ। ফুল চক্রাকার বা মোড়ানো, দেখতে খুব আকর্ষণীয় হলেও তা পাতার আড়ালে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। গ্রীষ্মকালে ফুল ফোটে। ফুলে বিশ্রী গন্ধ রয়েছে—অনেকে বলে বিষ্ঠার মতো। ফুল ফোটার প্রথম কয়েক ঘণ্টাজুড়ে এরকম গন্ধ ছড়ায় ঘেঁটকচু। শত্রুর হাত থেকে ফুলকে রক্ষা করার এ এক ছল মাত্র উদ্ভিদটির। 

ফল রসালো, বেরি। সবুজের ওপর বেগুনি ছোপ কাঁচা ফলে, পাকা ফল সাদা। এগুলো চ্যাপ্টা-গোলাকার, বীজ ১-২টি। সাধারণত শরৎ পর্যন্ত ফলের দেখা মেলে। এর গেঁড় বা কন্দ খাওয়া যায় অন্যান্য অনেক কচুর মতো। এগুলো সাদা রঙের, অর্ধগোলাকার কিংবা নলাকার, ১-৫ সেমি প্রশস্ত। 

আগেই বলা হয়েছে, এর পাতা ও বোঁটা সুস্বাদু সবজি হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে। ঔষধ হিসেবে এর কন্দ, ডাঁটা ও পাতা ব্যবহৃত হয়। ঘেঁটকচুর মূল ও কন্দ উত্তেজক। কন্দ কটু স্বাদের। বিষাক্ত সাপ, মৌমাছি, বোলতা ও বিছার কামড়ে এবং শক্ত ফোঁড়ায় পুলটিস হিসেবে উদ্ভিদটির ব্যবহার রয়েছে কোথাও কোথাও। কন্দের তরকারি ভাতের সাথে খেলে পায়খানা পরিষ্কার হয়, রক্তস্রাব কমে। অর্শরোগেও লোকজ চিকিৎসকরা তা প্রয়োগ করে থাকেন। ডাঁটা ও কন্দের তরকারি খেলে পেটব্যথা কমে, বায়ু নিঃসরিত হয় ও ক্ষুধা বাড়ে।  

মজার ব্যাপার, এত যার ঔষধি গুণ, ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে কিন্তু এর উল্লেখ নেই। এর ফুলের দুর্গন্ধের কারণেই কি তা, নাকি ওষুধবিদদের চোখ ফাঁকি দিয়েছে সুপ্রাচীনকাল থেকে—প্রশ্নটা রয়েই গেল মনে। উদ্ভিদটি বংশ বৃদ্ধি করে বীজ ও গেঁড় দিয়ে। 

বাংলাদেশ বা বৃহৎ বাংলা ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, উত্তর মালয়েশিয়া উদ্ভিদটির আদি বাসভূমি বলে স্বীকৃত। এর ভৌগোলিক ব্যাপ্তি অবশ্য আরো কিছু অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে। ফিলিপাইন, পশ্চিম বোর্নিও, সিঙ্গাপুর, পশ্চিম আফ্রিকা এবং আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলেও এখন এর দেখা মিলবে। 

এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Typhonium trilobatum, ইংরেজিতে বলে Bengal Arum। ভুঁইফোঁড়টি Araceae পরিবারের সদস্য। 

Comments

Popular posts from this blog

লাল সোনাইল, Java cassia, Cassia javanica

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

শিলকড়ই, Albizia procera