করচ, Dalbergia reniformis
অকূল সায়রের করচ
মোহাম্মদ আলি
করচ নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তির শেষ নেই। এ বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে আরেকটি পানিপছন্দ বৃক্ষ, সেটি করঞ্জা। তবে সে-কথা পরে।
আমাদের হাওর এলাকার একান্তই স্থানীয় গাছ করচ। জলজ বৃক্ষ কথাটা অদ্ভুত শোনালেও এতে অত্যুক্তি নেই। হাওরের অথৈ পানিতে অনেকেই গাছটিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হন। আসলে সুদীর্ঘকালের জীবনসংগ্রামে পুরো ভেজা মৌসুম জুড়ে, দীর্ঘ সময়--বছরের প্রায় ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে ভরপুর পানিতে টিকে থাকার জন্য অভিযোজিত হতে হয়েছে তাকে। ঠিক একই অভিযোজনক্ষমতা রয়েছে আমাদের দেশের আরেক জলজ বৃক্ষ হিজলের। করচের আদর্শ সহচর সে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি পানিপ্রেমী বৃক্ষের কথা না বললেই নয়, সে পানিজমা; আরেক নাম পানিবট; বিয়াস বলেও জানে লোকে। তবে এ গাছটি ঠিক হাওরের নয়, বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশের কয়েকটি জেলায় কেমন একটা শ্রীহীন অবস্থায় খাল, বিল ও নদীর ধারে অর্ধ জলমগ্ন অবস্থায় একে দেখতে পাওয়া যায়।
অনেকে আমরা জানি, ‘সাগর’ শব্দটি লোকমুখে বিবর্তিত হতে হতে ‘সায়র’ রূপ ধরে ‘হাওর’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। তার মানে, স্থানীয় লোকের কাছে তাদের হাওরই সাগর। বর্ষামৌসুমে দেশের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের এ জলাগুলো সত্যিই সাগরের মতো রূপ লাভ করে। এতই বিস্তৃত এলাকা জুড়ে উতালপাতাল পানি জমে যে, স্থানীয় নদী, নালা, খাল, বিল পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে বিশাল জলাভূমির রূপ নেয় তখন; কোনো কূলকিনারার দেখা মেলে না অনেক সময়। আর এই বিপুল-বিশাল জলাভূমিতেই জন্মে আমাদের একান্ত দেশীয় গাছ করচ। বাংলাদেশ ছাড়া খুব একটা বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকা জুড়ে এর উপস্থিতি নেই, কেবল ভারত ও মিয়ানমারের জলাভূমিতে এর দেখা মিলবে।
দেশের নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ (থাকতে পারে মৌলভীবাজার হাওরেও) ও সিলেটের হাওরগুলোতে অবস্থানকারী বৃক্ষটি খুব একটা উচ্চতা পায় না, মোটের ওপর ১০-১৩ মিটারের মতো। হিজলের মতোই ঝোপালো গড়নের ছোট বা মাঝারি আকারের গাছটি কলোনি করে, অর্থাৎ একসাথে অনেকগুলোকে অবস্থান করতে দেখা যায়। ডালপালা-পাতাবহুল গাছটির কাণ্ড কিছুটি বাদামি-রেশমি। তবে কিছু দিনের মধ্যে কাণ্ডের রেশমি ভাবটি আর থাকে না। পাতাগুলো এর ছোট ছোট, আয়ত-বল্লমাকার, সামান্য পুরু। একেকটি পক্ষলের আকার ১৫-৩২ সেমি, পক্ষলে পাতাসংখ্যা ৭-৯, একান্তর, অর্থাৎ পাতাগুলো একই উৎস থেকে না গজিয়ে একটার পর একটি গজায়। জোড়ায় জোড়ায় ৩-৪ জোড়া জন্মে, আগার ঠিক মাঝখানে একটি, এ-কারণেই চূড়াপক্ষল; গাঢ় সবুজ রঙের চকচকে ও মসৃণ, উল্টোপিঠ ফ্যাকাশে সবুজ, ৬-১০ সেমি লম্বা ও ৩-৫ সেমি চওড়া, বোঁটাধারী, কিনারা সমান বা দাঁতাল নয়, গোড়ার দিকটা গোলাকার, আগায় কিছুটা সুঁচালো।
ফুলের মৌসুম বসন্ত। ১০-১৩ সেমি লম্বা কাক্ষিক আর বাদামি ও সূক্ষ্ম রোমাবৃত মঞ্জরীদণ্ডে ফুলগুলো সাদা রঙের; ফ্যাবাসি (Fabaceae) পরিবারে যা হয়, শীমফুল আকৃতির, তবে বেশ ছোট। বৃতি ৫-দন্তক, পাপড়ি ঠোঁটের মতো বাঁকানো।
ফল উদ্ভিদবিদ্যার ভাষায় শীম, ২.৫-৩ সেমি-এর মতো লম্বা আর ৫-৭ সেমি-এর মতো। এগুলো কিডনির মতো দেখতে। শুকিয়ে গেলে গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করে। বীজ সাধারণত ১টি, তবে ২টিও বিচিত্র নয়। এর বীজগুলোও কিডনির মতো। ফ্যাবাসি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের মতো এরও বংশ বৃদ্ধি চলে বীজের মাধ্যমে।
করচের আরেক দেশীয় নাম কুরেস। গাছটির অনেক গুণ। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ গুণ--ঝড়ঝঞ্ঝা আর প্রবল বাতাস থেকে বসতবাড়িকে রক্ষা করা। এ ছাড়া ভূমিক্ষয় রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। লাকড়ি হিসেবেও ব্যবহার করা চলে। ঔষধি গুণাবলিও রয়েছে নিশ্চয়ই, তবে তা জানা যায়নি।
শুরুতেই বলা হয়েছিল, করচকে নিয়ে কমবেশি বিভ্রান্ত আমরা সবাই। বেশিরভাগ লোক একে সম্পূর্ণ গুলিয়ে ফেলেন আমাদেরই আরেক দেশীয় ঔষধি বৃক্ষ ‘করঞ্জা’র সাথে। অজ্ঞতার পাশাপাশি গুলিয়ে ফেলার অবশ্য বেশ কয়েকটা কারণও রয়েছে। দুটি গাছই একই পরিবারের, অর্থাৎ ফ্যাবাসি পরিবারের সদস্য, যদিও এদের গণ ভিন্ন। তবে গাছের উচ্চতা, পত্রবাহুল্য, পাতার রঙ আর ফুল ও ফলের গড়নে কিছুটা মিল রয়েছে। দূর থেকে একরকম মনে হলেও কাছ থেকে নিরীক্ষণের পর সব জট অবশ্য খুলে যাবে। উচ্চতা দুটি গাছের প্রায় একই। দুটিই পত্রবহুল গাছ, তবে পাতায় বেশ অমিল। করচের পাতা আগেই বলা হয়েছে আয়ত-বল্লমাকার, আর করঞ্জার পাতা ডিম্বাকার কিংবা প্রশস্ত বল্লমাকার, আকারে করচের চেয়ে বেশ বড়, ১০-১৫ সেমি। করচের ফুলের রঙ সাদা, করঞ্জারটি গোলাপি-সাদাটে বা মৃদু বেগুনি। উল্লেখ্য, করচ বসন্তে ফোটে, করঞ্জার মৌসুম গ্রীষ্মকাল। করচের ফল আর বীজ দুটিই কিডনির আকৃতির (যে-কারণে দ্বিপদী নামের শেষের অংশের নাম রেনিফরমিস--Reniformis), অন্যদিকে করঞ্জার ফল আকারে বড়, ডিম্বাকার, ভেতরের দিকে চ্যাপ্টা, আগা ও গোড়া লম্বাটে, ৪-৫ সেমি লম্বা, বীজ ১-৩টি।
হাওরের পানিপ্রবাহ ঠিকমতো নিশ্চিত করা আর বসতভূমির ক্রম আগ্রাসন না ঠেকানো গেলে প্রকৃতির অনন্য এ সদস্যকে আমরা হারাতে বসব, এটা নিশ্চিত। আইইউসিএন-এর তালিকায় একে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ভিদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আশার কথা, করচের সংখ্যাহ্রাসের কথা বিবেচনা রেখে বাংলাদেশ সরকার হাওর এলাকায় এর বেশ কিছু গাছ রোপণ করায় সাময়িকভাবে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচতে যাচ্ছে দেশীয় এ বৃক্ষটি। বিচিত্র প্রকৃতির অনন্য এ সদস্যকে তার বাস্তুভূমিতে ও দেশের বিস্তৃত অন্যান্য জলাভূমিতে রোপণের মধ্য দিয়ে চাইলেই সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারি আমরা। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেশের সরকারি উদ্ভিদ-উদ্যানগুলোতে ঠাঁই দিয়ে একে রক্ষার ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে।
* সবগুলো ছবি তোলা হয়েছে ১৮ জুলাই ২০২২, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওর থেকে।
Comments
Post a Comment