করপুলা, Sarcolobus carinatus

করপুলা, Sarcolobus carinatus, Family: Asclepiadaceae.

স্থানীয় নাম : বাওলিলতা, বাওনিলতা, বান্দালিলতা।

অনন্তমূল কিংবা অপরাজিতার মতো পেঁচিয়ে, আষ্টেপৃষ্ঠে বাড়ে সুন্দরপত্রী, ক্ষীণতনু লতাটি। আমাদের দেশের লোকেরা বলে করপুলা, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাওলি-লতা। দ্বিপদী নাম Sarcolobus carinatus। দেশের দক্ষিণের সাগরপারে দুধকষে ভরা লতাটির বসতি। সুন্দরবনের উভয় অংশে একে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া রয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ম্যানগ্রোভ বনে-উপবনে। অথচ আমাদের উদ্ভিদ-রসসাহিত্য তো বটেই দুয়েকটা তথ্যভাণ্ডার ছাড়া পুরোপুরি উপেক্ষিত।

আশ্রয়দাতার পাতার মতোই অনেকটা এর পাতা। তাই খুব সহজে, হঠাৎদৃষ্টিতে একে আলাদা করে উপভোগ করা যায় না। আশ্রয়দাতা আমাদের ভুবনমোহিনী, চিত্রবিচিত্র ম্যানগ্রোভ-উদ্ভিদ গেওয়া, স্থানীয়রা বলে গাওয়া, ইংরেজিতে Blind your eye (Excoecaria agallocha)। পাতা গেওয়ার পাতার চাইতে প্রায় আধাআধি ছোট, রঙ একইরকম। অনুমেয়, লতাটির Mother plant এটি।


যতবারই এ বল্লীকে দেখেছি প্রতিবারই কেওড়া-বনের ঘনঘটায় থাকা গেওয়া-ঝাড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকতে দেখেছি। জীবের মনোহরা এ চাতুরী মনে দারুণ এক দোলা দিয়েছিল সে অভিযানের দিনগুলিতে। ঘোর গ্রীষ্মে, আমপাকা গরমে, অল্পবিস্তর সামুদ্রিক দুর্বিপাকে ঘুরতে গিয়েছিলাম হাতিয়া ও নিঝুমদ্বীপে। সেখানকার সাগরপারের জোয়ার ও লবণ-পানিবিধৌত ছোটবড় বনভূমিগুলিতে এর বসবাস। 

আমাদের ছোট্ট ভ্রমণদলে সঙ্গী হিসেবে জুটে গিয়েছিল দুষ্টুচঞ্চল একপাল ছেলে। ওরা উপভোগ করেছে আমাদের সাহচর্য, আমরাও তাই। আমাদের গাছপাগলামি ওদেরও মন জয় করল। আমরা গলায় এর লতা পরলাম, ছবি তুললাম। ওরা অত্যুৎসাহে আমাদেরকে এর অভিনব ফলগুলো দেখাল। খেয়ে দেখাল সেই কষ বের হওয়া, কামরাঙ্গার আকৃতির, ইঞ্চি দুই-আড়াই লম্বা ফল। দুয়েকজন ছেলেবুড়োসহ কেউ বাদ রইল না, সবাই কচকচ করে খেয়ে দেখাল রম্য ফলগুলোকে। শেষে আমাদের উপভোগপর্ব ভোগপর্বে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নিল না; আমরাও কচকচ করে খেতে শুরু করলাম কাঁচা ফলগুলকে--কষ বিন্দুমাত্র ঝামেলা করেনি। করপুলা নিয়ে স্থানীয়দের এ উন্মাদনা সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকুক আমার মনে! খেতে পানসে স্বাদের হলেও রুচিতে বিঘ্ন ঘটায়নি ফলগুলো। গোটা-কয়েক খেলে পেট ভরবে নিশ্চিত। পুরুষ্ট ফলগুলোতে যদ্দূর মনে পড়ে কোনো বিচি ছিল না, থাকলেও টের পাইনি তখন। কাঁচা ফল ভোগ্য; পাকা ফল ভোগ্য কি অভোগ্য, জানা যায়নি। 

করপুলার পাতা কিছুটা ফিকে সবুজ, বৃত্তাকার কিংবা বিডিম্বাকার, নয়তো লম্বাটে ডিম্বাকার, ৩-৬ সেমি লম্বা, ১-২ সেমি চওড়া, পুরুষ্ট, উপরনিচ মসৃণ, গোড়ার দিকটা চিকন, আগা ভোঁতা কিংবা কিছুটা সুঁচালো। 

এর ফুল সহজিয়া-সুন্দর, ছোট ছোট নাকছাবির মতো, তারার মতো; ফিকে কমলাটে হলুদ, ৫-পাপড়িবিশিষ্ট, সাধারণত ৩-৪টি একই মঞ্জরীতে; গন্ধ পাইনি--যদ্দূর মনে পড়ে। ফুল ফোটা শুরু করে ফেব্রুয়ারিতে।

ফল ডিম্বাকার, ৫-৬টি শিরায় স্পষ্টভাবে বিভক্ত--অনেকটা কামরাঙ্গার মতো, ৪-৫ সেমি লম্বা, ২ সেমি চওড়া, আগা সুঁচালো ও বাঁকা। কাঁচা ফল গাঢ় সবুজ, ভাঙলে দুধকষ বেরোয়, পাকাগুলো লালচে বাদামি।

আরোহী কিংবা মাটিতে গড়ানো করপুলা বা বাওলি খুব একটা বিস্তৃত লতা নয়, মানে প্রসারিত নয় তেমন একটা। আমাদের প্রাকৃত উদ্ভিদের একটি এটি। দেশের বাইরে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাগরস্নাত বনভূমিতে রয়েছে এটি; বিশেষ করে উপমহাদেশীয় সাগরপার, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, চীনের কিছু অংশ, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে এর দেখা মিলবে। 

লবণপানি-বিধৌত এলাকার বাসিন্দা আমাদের মূল ভূমির স্বাদু পানির এলাকায় টিকবে কিনা, জানি না, টিকে থাকলে আমাদের সখের বাগান, স্বদেশি বাগান গড়বার জন্য সুন্দরতনু লতাটির অন্তর্ভুক্তি দারুণ শ্লাঘার বিষয় হতে পারে।

এর দ্বিপদী নাম অনেক, অনেকবার পাল্টেছে। সমনামের তালিকা দেখলেই তা বোঝা যাবে।

Sarcolobus banksiiS, arcolobus beccarii, Sarcolobus borneensis, Sarcolobus brachystephanus, Sarcolobus ciliolatus, Sarcolobus globosus, Sarcolobus hullsii, Sarcolobus kaniensis, Sarcolobus lifuensis, Sarcolobus luzonensis, Sarcolobus merrillii, Sarcolobus minor, Sarcolobus multiflorus, Sarcolobus narcoticus, Sarcolobus oblongus, Sarcolobus pierrei, Sarcolobus porcatus, Sarcolobus quinquangularis, Sarcolobus retusus, Sarcolobus ritae, Sarcolobus rubescens, Sarcolobus secamonoides, Sarcolobus spanoghei, Sarcolobus spathulatus, Sarcolobus submucronatus, Sarcolobus subnudusa, Sarcolobus sulphureus, Sarcolobus venulosus, Sarcolobus virulentus, Sarcolobus vittatus, Sarcolobus warburgii.


Comments

Popular posts from this blog

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

রসুন, Garlic, Allium sativum