পেঁয়াজ Common onion, Allium cepa
সুকন্দ পেঁয়াজ
মোহাম্মদ আলি
বাঙালির কাছে পেঁয়াজের প্রসঙ্গ পাড়া বাতুলতা-মাত্র। কিন্তু একটা ব্যাপারে প্রশ্ন আছে, পেঁয়াজের ফুল কেউ দেখেছেন কখনো? নিশ্চয়তা দিচ্ছি, বাগানের অন্য অনেক বাহারি ফুলকে হার মানাবে এর ফুল। বিশেষ করে আমাদের দেশে কোনো একটি শীতকালীন ফুল যেভাবে রোপণ করা হয় সারে সারে, নির্দিষ্ট একটা বেডে, ফুটন্ত পেঁয়াজের বেড দেখলে সেরকম শোভা উপভোগ করা যাবে শতভাগ। বাগানে কেউ পেঁয়াজকে স্থান দিয়েছে কিনা জানা যায় না, তবে গ্রামের ক্ষেতে ফুলেল পেঁয়াজের যে সমৃদ্ধি দেখা যায় তা দুরন্ত এক ভাবের খেলা মনের মধ্যে আনবে যে-কারোর মধ্যে, আমি নিশ্চিত।
নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, খুব প্রাচীনকাল থেকে পেঁয়াজ চাষ হয়ে আসছে এশিয়াতে। হিসাবটা করতে গেলে তা দাঁড়ায় ৭ হাজার বছরে। উদ্ভিদ-বিশেষজ্ঞরা তাই ধাঁধায় পড়ে যান এ উদ্ভিদের জন্মস্থান নিয়ে। তবে মধ্য এশিয়া এর মাতৃভূমি বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করে থাকেন। উৎপত্তি যেখানেই হোক, বর্তমানকালের কথা যদি ধরি, কোথায় না পাওয়া যায় পেঁয়াজ! দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই এর চাষ হয় খুব যত্ন-আত্তি সহকারে। কেননা এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সুস্বাদু সবজিগুলোর অন্যতম, একই সাথে সুস্বাদু মসলারও অন্যতম।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সাহিত্যকর্মে পেঁয়াজের উল্লেখ রয়েছে কিনা তা-ই এবার যাচাই করা যাক। ঋকবেদের এক কাহিনির চরিত্রের সাথে যোগ রয়েছে পেঁয়াজের। অথর্ব বেদের উপবর্হণ সংহিতায় বেশ গুণকীর্তন করা হয়েছে এর। এর পরের সাহিত্যকর্মের মধ্যে একে উল্লেখ করা হয়েছে 'পলাণ্ডু' হিসেবে। পল শব্দের অর্থ মাংস। পেঁয়াজ সিদ্ধ করলে মাংসের মতো থলথলে হয় বলেই এর এমন নাম। আর শেষের অংশ 'অণ্ডে'র অর্থ ডিম। পলাণ্ডুর মানে দাঁড়াল তাহলে 'মাংসল ডিম'! পেঁয়াজের আকৃতি কিছুটা ডিমের মতো বলেই হয়ত সংস্কৃত-পণ্ডিতরা এর এমন নাম রেখেছেন। চরক-সুশ্রুততেও এর উল্লেখ রয়েছে উজ্জ্বলভাবে। পেঁয়াজের মজার নামও রয়েছে; এর একটি মুখদূষক। পেঁয়াজপ্রীতি যাদের রয়েছে তারা মনে করেন, কাঁচা পেঁয়াজ খেলে দাঁত-মুখের রোগ হয় না। আর পেঁয়াজবিদ্বেষীরা বলেন, এটা খেলে নাকি মুখে দুর্গন্ধ হয়।
নামবিদ্যার এত ঐতিহাসিক ঝলক সত্ত্বেও এর বর্তমান নাম 'পেঁয়াজ' কিন্তু এসেছে ফারসি শব্দ 'পয়াজ' থেকে। তবে এটা সত্য, পেঁয়াজ দারুণ এক ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। সে কথায় পরে আসছি। এবার চলুক এর অঙ্গকীর্তন।
উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় পেঁয়াজ উদ্ভিদটি একটি বীরুৎ, নরমশরম কিন্তু খাড়া। খুব একটা বড় হয় না, মাত্র এক মিটারের মতো হতে পারে বড়জোর। একটা কথা বলে রাখা ভালো, পেঁয়াজকে অনেক সময় বর্ষজীবী বীরুৎ বলা হয় ফসলের অভিধা দিয়ে। এর কারণও আছে। যে পেঁয়াজ চাষ করবে তার দরকার এর মাটির নিচেকার প্রাণভোমরা পেঁয়াজ। তাই নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজ তুলে ফেললে এটি তো একর্ষজীবী অভিধা পাবেই। খাদ্যসঞ্চয়কারী কন্দটি উঠিয়ে ফেলা মানেই পেঁয়াজ উদ্ভিদকে মেরে ফেলা। আসলে উদ্ভিদটি দ্বিবর্ষজীবী কিংবা বহুবর্ষজীবী। আর বীরুৎ বলতে আমরা বুঝি, সাধারণত এক বছর যার আয়ুষ্কাল; মানে কিনা, এক বছরের মধ্যেই সে ফুলফল দিয়ে নিজের জীবনমরণখেলা খেলবে। আমাদের পেঁয়াজ, রসুন, আদা বা এ-জাতীয় অনেক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এ নিয়মটা চলে না।
পেঁয়াজের পাতাগুলো খুব সুন্দর, পাতা বলতে যা বুঝি, তা নয়। সবুজ রঙের নলাকার পাতাগুলো মাটির নিচেকার কন্দ থেকে বের হয়ে সোজা উপরে উঠে যায়। পাতাগুলো মাংসল এবং ফাঁপা। সত্যিকার অর্থে পুরো গাছটিই মাংসল এবং ঝাঁঝালো। পেঁয়াজের পাতা দুই সারিতে জন্মায়। একেকটি ২৫-৪৫ সেমি লম্বা, চকচকে ও মসৃণ, আগের দিকে চোখা।
সবাই জানে, পুরো গাছটি ঝাঁঝালো গন্ধের। সবচেয়ে বেশি গন্ধ এর পেঁয়াজে, যা কিনা রূপান্তরিত কাণ্ড, মূল নয় মোটেও। মানে কিনা কাণ্ডটাই মাটির নিচে গিয়ে স্ফীত হয়ে কন্দের রূপ নেয়। আর এ কন্দটির আবরণ থাকে পাতার রূপান্তরিত অংশ দিয়ে মোড়ানো। আবার রূপান্তরিত এই কাণ্ডের নিচে অর্থাৎ পেঁয়াজের নিচে এক মুঠো দাড়ির মতো অগভীর শিকড় রয়েছে। সব মিলিয়ে এক বৈশিষ্ট্যময় উদ্ভিদের নাম পেঁয়াজ। শুধু এই নয়, জীবন রক্ষার তাগিদে সে বেশ চাতুরিরও আশ্রয় নেয়। পেঁয়াজ কাটার সময় আমাদের অনেকের চোখ জ্বলে, পানিও চলে আসে। এতে বোঝা যায়, তার শত্রুপক্ষ যাতে তার জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে না দেয়, আপনা থেকেই সেই ব্যবস্থা করে নিয়েছে পেঁয়াজ। জীবন রক্ষার এ মনোহরা চাতুরির পরও তার কিছু শত্রু থেকে যায়। পেঁয়াজ-মাছি বা অনিয়ন ফ্লাই নামের এক ধরনের পোকা এর প্রধান শত্রুদের অন্যতম। এ ছাড়াও এমন অনেক পোকামাকড় রয়েছে যারা এর পাতাসহ মাটির নিচেকার পেঁয়াজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পিছপা হয় না।
পেঁয়াজের ফুল অসাধারণ দেখতে। খাড়া ও নিষ্পত্র পুষ্পদণ্ডে অনেকগুলো ফুল একসাথে থাকে হেড-জাতীয় পুষ্পবিন্যাসে, চক্রাকারে। উভলিঙ্গী ক্ষুদ্র ফুলগুলো সাদাটে রঙের। ফল ক্যাপসুল, আঠালো। ফলের বীজ ছাড়াবার প্রক্রিয়া চমৎকার। এটি চারদিক থেকে সমানভাবে ফেটে গিয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বীজগুলো চ্যাপ্টা, কালো রঙের। পেঁয়াজের চাষ দুভাবে হতে পারে; হয় বীজ থেকে, আবার হতে পারে কন্দ থেকেও। বাজার থেকে কিনে আনা পেঁয়াজ বাড়িতে রাখলে কিছুদিন পর এর মাথা থেকে পাতার কুঁড়ি বেরোতে দেখা যায়। এ পেঁয়াজ মাটিতে পুঁতে দিলে পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নেয় না।
পেঁয়াজের শুকনা খোসার রঙ হতে পারে পাটকিলে (ইটের রঙ), হলদে, বাদামি রঙের। আবার এর ভেতরের মাংসল অংশের রঙ হতে পারে লালচে, বেগুনি, সাদা অথবা ঘিয়ে রঙের।
আমাদের দেশে পেঁয়াজকে চাষ করা হয় রবি ফসল হিসেবে, অক্টোবর থেকে মার্চে। প্রায় সারা দেশেই এর চাষ হয়। তারপরও বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় আমাদের ঘাটতি-চাহিদা পূরণের জন্য। বিশ্বের প্রধান পেঁয়াজ-উৎপাদনকারী দেশ চীন; তারা উৎপাদন করে সারা বিশ্বের উৎপাদিত পেঁয়াজের শতকরা ২০ ভাগ। এর উৎপাদনে চীনের পরেই রয়েছে ভারত, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র। ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর বৈচিত্র্য থাকাতে ভারত প্রায় সারা বছরই পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারে বলে এক সূত্র থেকে জানা যায়। বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াবার জন্য শুধু রবি মৌসুমে চাষ না করে গরমে তা চাষ করার মতো কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
পেঁয়াজ দিয়ে কী না করা যায়! একে সালাদের সাথে, বিশেষ করে টমেটো ও শশার সাথে মিশিয়ে খেলে দারুণ স্বাদ লাগে। পান্তা ভাত পিঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে খেলে স্বর্গীয় আনন্দ পাওয়া যায়। ব্যাচেলরদের শ্রেষ্ঠতম খাবারের একটি ডিম। মরিচের সাথে পেঁয়াজ দিয়ে ডিম ভাজলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম খাবারও হার মানতে চায়। রান্নায় যে কতরকমভাবে এর ব্যবহার রয়েছে তা অভিজ্ঞ গৃহিণী বা বাবুর্চিরা ভালোভাবে জানেন। পেঁয়াজের আচার অমৃত। যেকোনো ভাজা মাছের সাথে কাঁচা পেঁয়াজের ফালি খুবই মুখরোচক। ঝালমুড়ির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান এটি। গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা অনেক ফলফলাদির ভর্তা বানায় পেঁয়াজ মিশিয়ে। চা-বাগানের অতি গরিব শ্রমিকরা কচি চা-পাতার সাথে পেঁয়াজ মিশিয়ে ভর্তা বানিয়ে খায়। শীতকাল আসলে অন্যান্য সবজির সাথে পেঁয়াজের পাতাকেও আমরা অহরহ রান্নায় ব্যবহার করে থাকি। সালাদ হিসেবেও পাতার ব্যবহার রয়েছে।
২০২০-২১ সালের বৈশ্বিক অতিমারি করোনার জন্য আমাদের দেশে পেঁয়াজ সংকট হলে ভারতকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে তা আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত এই পেঁয়াজের চেহারা-সুরত (আকার-আকৃতি, রঙ) আর ঝাঁঝের অনুপস্থিতি দেখে সাংঘাতিক হাসাহাসি লেগে গিয়েছিল আমাদের দেশে। আসলে একই প্রজাতির পেঁয়াজ জলবায়ু-মাটির বৈচিত্র্যের কারণে বিচিত্র আকারপ্রকার পায়; রঙ আর স্বাদেও ভিন্ন হয়। পেঁয়াজের ধারেকাছে আরও কয়েক ধরনের (ভিন্ন প্রজাতির) পেঁয়াজ এশিয়া-ইউরোপে জন্মায়। তবে গুণে মানে সেরা এই পেঁয়াজ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে পরম আদরণীয় হিসেবে রয়েছে অন্তত ৭ হাজার বছর আগ থেকে।
পেঁয়াজের উদ্ভিদাত্ত্বিক নাম Allium cepa, ল্যাটিন Cepa-এর অর্থ পেঁয়াজই। এর ইংরেজি নাম Onion বা Common onion। আরেকটি নাম আছে এর, সেটি Bulb onion। পেঁয়াজকে বিজ্ঞানীরা ফেলেছেন Amaryllidacea পরিবারে। লেখার শুরুতে যে পেঁয়াজফুলকীর্তন করেছিলাম এতে অনেক পাঠক হয়তো ধরে ফেলেছেন যে, এই পরিবারের অন্য অনেক সদস্য বাহারি ও বর্ণোজ্জ্বল ফুলদায়ী। সুতরাং পেঁয়াজফুল যে দেখতে সুন্দর হবে, তা বলা বাহুল্য।
পেঁয়াজের একেবারেই ঘনিষ্ঠ সহচর রসুন, অন্তত রান্নার ক্ষেত্রে এ দুটির নাম একবারে উচ্চারিত হয় ভোজনরসিকদের মুখে মুখে। এ দুটির বিজ্ঞান-পরিবার, এমনকি গণও এক। রসুনের দ্বিপদী পরিচয় Allium sativum।
ঔষধি হিসেবে পেঁয়াজের অনেক লোকায়ত ব্যবহার রয়েছে। সর্দিতে এর রস ব্যবহার করেন অনেকে। কষা প্রস্রাবে ঠান্ডা পানির সাথে পেঁয়াজের রস পান করলে উপকার পাওয়া যায়। রসের প্রয়োগে বমি করানো ও তা বন্ধ, দুইই করা যায়। দাস্ত, অর্শ ও হিক্কায় এর রস ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়া ও মাথা ধরায় এর রস নস্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় কোথাও কোথাও। স্তনের ফোঁড়াতে এর রস লাগালে তা সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুরনো ঘায়ের ক্ষেত্রে পেঁয়াজের রস পানিতে মিশিয়ে ধুলে তা সেরে যায়। পেঁয়াজের দুর্গন্ধের ব্যাপারে অনেকে আপত্তি করেন। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজ চিরে টক-দইয়ে ভিজিয়ে রাখলে এর বদগন্ধ চলে যাবে ঠিকই, ঔষধি-গুণের কোনো তারতম্য হবে না--পণ্ডিতরা এমন মত দেন।
লেখার শিরোনামায় যে 'সুকন্দ' যোগ করা হয়েছে, তা এসেছে পেঁয়াজের সংস্কৃত নাম 'সুকন্দক' থেকে।
Comments
Post a Comment