সাগরকন্যা সাগর-নিশিন্দা, Vitex trifolia

সাগরকন্যা সাগর-নিশিন্দা 

মোহাম্মদ আলি

নিশিন্দার কথা সেই ছোটবেলা থেকেই জানি। গানও শুনেছি একে নিয়ে। এ যে দারুণ ঔষধি গাছ, সেও জানতাম। ছোটবেলা থেকেই একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, যেসব ফলমূল-শাকসবজি তিতা স্বাদের, সেগুলোর পুষ্টিগুণ বেশি, ঔষধি গুণও বেশি। যেমন, করল্লার কথা জানি--তিতকুটে স্বাদের। কিন্তু এ সবজি এখন তো অমৃত লাগে খেতে। আমাদের নিশিন্দাও স্বাদে তিতা এবং একই সাথে ঔষধি গুণসম্পন্ন।


নিশিন্দা নিয়ে ছোটবেলার কথা থেকে এখন বড়বেলায় আসি। গিয়েছিলাম কক্সবাজার ঘুরতে একবার। বর্ষায় সাগরপারের বালুতে অযত্নে থাকা অবস্থায় কয়েকটি নিশিন্দাকে এক জায়গায় কলোনির মত একত্রে থাকতে দেখে বুঝে গিয়েছিলাম যে, এটা নিশিন্দাই হবে। আরেকবার গিয়েছিলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সেখানে ছত্রে ছত্রে নিশিন্দাকে দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। শীতের শেষে দেখি সাগরের ঠিক পাড়েই ওদের ঘনবসতি, ইতস্তত ছড়ানো ডালপালায় কেমন একটা শ্রীহীন অবস্থা। অধিকাংশের শরীরজুড়ে ফলের মেলা, ফুল ছিল কয়েকটি গাছে। একই অভিযানে কেয়া, সমুদ্রজবা, সমুদ্রকলমি ও পাইনা ফুলের সাথে ছেঁড়াদ্বীপে আরো ঘন অবস্থায় এদের দেখেছি একটা জায়গায় বেশ কায়দা করে জেঁকে বসেছে। অভিযান শেষ করে ঢাকায় এসে বইপত্র ওল্টাতেই দেখি এ তো নিশিন্দা নয়, এ সাগর-নিশিন্দা, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি। খুশিতে ঝলমল করে উঠল মন। জানতে পারলাম এর আরেক নাম নীল নিশিন্দা। 

মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই নিশিন্দা সাথে সাগর-নিশিন্দার পার্থক্য কী? সাগর-নিশিন্দা নিশিন্দার চাইতে একটু ছোট দৈর্ঘ্যের হয়, বড়জোর ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে উচ্চতা দিয়ে এদের দুজনের পার্থক্য বোঝা যাবে না। এর পাতা দিয়ে পার্থক্য কিছুটা চিহ্নিত করা যায়। যেমন, এর পাতার কিনারা কর্তিত নয়, স্বাভাবিক বা সরল। এর দ্বিপদী নামের প্রজাতির অংশের Trifolia কথাটার অর্থ ত্রিপত্রী, এর পত্রাক্ষে পাতার সংখ্যা ৩। পাতা গাঢ় সবুজ রংয়ের, বিডিম্বাকার (গোড়া সংকীর্ণ, আগা প্রশস্ত। অর্থাৎ, ডিমের আকৃতির উল্টো) থেকে ডিম্বাকার, নিশিন্দার মতো বল্লমাকার নয়। আগার পাতা অন্য দুটি পার্শ্বীয় পাতার চাইতে বেশ বড়। পাতা ২.৫-০.৭ সেমি লম্বা ও ০.৭-২ সেমি চওড়া। পাতায় বোঁটা নেই এবং এগুলো রোমহীন ও মসৃণ। তবে পত্রাক্ষের বোঁটা রয়েছে। বোঁটা ০.৫-৩.৫ সেমি লম্বা। প্রধান পাতা, যেটি বড়, সেটির বোঁটা মাত্র ২.৫-৬ মিমি লম্বা। তা ছাড়া পাতার গোড়া গোলাকার ও আগা কিছুটা চোখা কিংবা ভোঁতা। 

সাগর-নিশিন্দার কাণ্ড মসৃণ, রং ছাই-ধূসর। তরুণ ডালপালা প্রায় চৌকোনাকার, মখমলের মতো মিহি রোমাবৃত। কাণ্ডের গোড়া থেকে ডাল মুক্তভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গাছটি নিশিন্দার মতোই সুগন্ধি। 

সাগর-নিশিন্দাকে নীল নিশিন্দা বলা হয়ে থাকে এর উজ্জ্বল নীল রংয়ের ফুলের কারণে। পুষ্পমঞ্জরী ২.৫-১২ সেমি দৈর্ঘ্যের। হয় কাক্ষিক, নইলে শাখার চূড়ায় গজানো বহু শাখায়িত পুষ্পমঞ্জরীতে ফুলগুলো ধরে। অনেক সময় আরেকটু বড় দৈর্ঘ্যের মঞ্জরীও দেখা যায় কোনো কোনো গাছে। সেগুলো ২০ সেমি পর্যন্তও হতে পারে। অর্থাৎ নিশিন্দার মতো এই সাগর-নিশিন্দার পুষ্পমঞ্জরীও অনেক বড় হতে পারে। এর উভলিঙ্গী ফুলগুলো ঠিক নীল নয়, বেগুনি নীল, নিশিন্দার চাইতে একটু গাঢ় নীল। তবে সবসময় যে একই রং হবে পাপড়ির তা কিন্তু নয়। এগুলো হতে পারে মৃদু নীল, গোলাপি অথবা গোলাপি বেগুনি। ফুলে সুগন্ধ রয়েছে। বৃতিতে শিরা রয়েছে ৫টি এবং ৫-দন্তকও (খাজকাটা) বটে। পাপড়ির নিচের অংশ অন্যগুলোর চাইতে বড়। পুংকেশরগুলো মূল ফুল থেকে বাইরের দিকে প্রসারিত থাকে, গর্ভদণ্ডও তাই। 


ফল উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় ড্রুপ। ডিম্বাকার ফলগুলো বেশ ছোট, ৫ মিমি-এর মতো ব্যাসের। নিশিন্দার মতোই ফলগুলো পাকলে কালচে রং ধারণ করে। ফুল-ফলের খেলা চলে সারা বছর ধরে।

নিশিন্দার মতো আমাদের এই সাগর-নিশিন্দাও বড় আকারের গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ। এও পাতা ঝরায় শীতে। পাতা ঝরানোর পরপরই আসে প্রস্ফুটন। একে আমরা বলতে পারি প্রথম প্রস্ফুটন। মনে রাখা ভালো, যেসব গাছ শীতে পাতা ঝরায়, তাদের অধিকাংশেরই প্রস্ফুটন অন্যান্য সময়ের প্রস্ফুটনপর্বের চাইতে যে বেশি হয়, সেকথা আমরা কমবেশি জানি মাঠচর্চার ফলে।

পূর্ব আফ্রিকা থেকে শুরু করে সমগ্র এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া হয়ে একেবারে দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত এর দেখা মিলবে। আমাদের দেশে পুরো কক্সবাজার জেলার সাগরের পাড়ে সাগর নিশিন্দার দেখা মিলবে। কক্সবাজার, টেকনাফ, চকোরিয়া, মহেশখালি ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এর দেখা মিলবে বেশি করে। তবে আমাদের উপকূলীয় অন্যান্য এলাকায় খোঁজ নিলে এর দেখা মেলার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাগর-নিশিন্দার ডালপালা, এমনকি আস্ত গাছ তুলে এনে উপকূলীয় এলাকার লোকেরা জ্বালানির কাজ চালায়; যে-কারণে বেশ হুমকির মুখে রয়েছে সাগরকন্যাটি। গাছটি মানুষের সাক্ষাৎ বন্ধু। উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে এটি ঝড়ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বসতবাড়িকে রক্ষা করে গাছটি। মাটির ক্ষয় রোধও করে। কোথাও কোথাও এর শুকনা পাতা-পোড়া-ধোঁয়া মশা তাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ফল রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার তথ্যও রয়েছে। নোনা পানিযুক্ত মাটিতে টিকে থাকতে পারে তো বটেই, মজার ব্যাপার, গাছটি খরাসহিষ্ণুও।

সাগর-নিশিন্দার ভেষজ গুণ অনেক। পাতা ও শিকড়ের রসে রয়েছে ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণ ও বাতের ব্যথা দূরকারী গুণ। এর শিকড় মূত্রকারক ও শরীরের ঘাম দূরকারী। শিকড়ের ক্বাথ জ্বর ও যকৃতের রোগে ব্যবহৃত হয়। প্রসবকালীন জটিলতায়ও এর ব্যবহার রয়েছে। পাতলা পায়খানায় এর ছালের রস ব্যবহার করা হয়। শুকনো ফলের ক্বাথ ঠান্ডা, জ্বর, মাথাব্যথা, গ্লুকোমা, চোখ ভিজে যাওয়া, চোখব্যথা, বুকব্যথা ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয়। পাতার পুলটিস বেরিবেরি রোগে ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে কোনো স্থানে।

সাগর-নিশিন্দার বেশ কয়েকটি সংস্কৃত নাম রয়েছে; সেগুলোর মধ্যে জলনির্গুণ্ডি, সিন্ধুকা, সুগন্ধি, ভূতকেশী, ইন্দ্রানী, নীলিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলায় কোথাও কোথাও একে পানি-সামালুও বলা হয়ে থাকে।

এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক বা দ্বিপদী নাম Vitex trifolia; গাছটি Verbenaceae পরিবারের সদস্য। এর ইংরেজি নাম Simpleleaf chastetree।  

ছবি তোলার স্থান : ইনানী সমুদ্রসৈকত, সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ

Comments

Popular posts from this blog

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

রসুন, Garlic, Allium sativum