শাপলা, Nymphaea pubescence

বাঙালিমণি শাপলা

শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। বাঙালভূমির গৌরবের অংশীদার করে জাতীয় প্রতীকেও তাকে সম্মানজনক অবস্থান দেয়া হয়েছে। লতানো বীরুৎটি আমাদের পানিপ্রধান ভূমির একান্ত স্মারক। দেশের আনাচে-কানাচের মাঠঘাট, ফসলি জমি, পতিত জমি, খালবিল, পুকুর, খানাখন্দক, যেখানেই পানি স্থির হয়ে থাকে, সেই জমাট ও অগভীর জলাশয়ে শাপলার রাজত্ব চলে। দেশের জলজ উদ্ভিদের মধ্যে সে সুন্দরতমের একটি--শুধু ফুল নয়, নয় তার কুঁড়ির বাহার, দেহবল্লরীও তার প্রায় অতুলনীয়। আবার এর পাতার গাঢ় সবজেটে সৌন্দর্যে আমরা যে শুধু বিভোর থাকি তা কিন্তু নয়, এর বোঁটার দীঘল, তুলতুলে ও গোলগাল মনোহরা সর্পিল বাহার, ফল ও ডাঁটার ক্ষুদ্বৃত্তির মাহাত্ম্য--সব মিলিয়ে একান্তই বাঙালিমণি হিসেবে সে ধরা দেয় আমাদের কাছে। 

এ তো গেল শাপলাপ্রশস্তি। এর পর কিছু অপ্রিয় কথা না বললেই নয়। একে নিয়ে রয়েছে অনেক অনেক বিভ্রান্তি। বিভিন্ন রঙের শাপলা যে আমরা একই জলায় সচরাচর দেখি, সবার নামই কি শাপলা? আর শালুকই-বা কোনটি? বাংলাভাষায় লেখকদের মধ্যে এ বিভ্রান্তি পুরানো, কয়েকদিন আগপর্যন্ত বৈজ্ঞানিক মহলও সে বিভ্রান্তি থেকে বাদ ছিল না। এ বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে এর ফুলের রঙ, বলা ভালো ফুলের রঙবৈচিত্র্য। আমাদের এই শাপলার বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea pubescence। এই একই প্রজাতির উদ্ভিদটির ফুলে রয়েছে তিন-তিনটি রঙের উপস্থিতি। সোজা কথায় শুধু সাদা নয়, এর আরো দুটি রঙ রয়েছে। প্রথমটি লাল আর দ্বিতীয়টি সাদা ও লালের মিশ্রণে আরেকটি। এই 'আরেকটি' আবার স্থান ও পাত্র ভেদে মৃদু লাল, গোলাপি; তাই একে লালচে বলে এগুনোই ভালো। বাংলা প্রবাদে ঠাট্টা করে একটা কথার চল রয়েছে-- শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর; নানারকম শাপলার ভিড়ে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা চেনা সত্যিই কঠিন। তাই দ্বিপদী ওই বৈজ্ঞানিক নামই ভরসা, যেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। 

শাপলা Nymphaeaceae পরিবারের। এ পরিবারে রয়েছে ৭০টির মতো সদস্য। আবার Nymphaea গণের প্রজাতিসংখ্যা ৪৬। সুতরাং গণ্ডগোল পাকাবার মতোই যথেষ্ট রসদ যোগাচ্ছে খুব কাছাকাছি ধরন-বরনের সদস্যরা। মনে রাখা দরকার, Nymphaea pubescence প্রজাতির শুধুমাত্র সাদা শাপলাই আমাদের জাতীয় ফুল; লালও নয়, লালচেটি বা অন্য প্রজাতির শাদা শাপলা, কোনোটিই নয়। সাদা শাপলা বলে ইদানীং আমাদের দেশের কোথাও কোথাও যে যেটি দেখা যায় তা কিন্তু Nymphaea alba, বিদেশি উদ্ভিদ। আবার লাল রঙের যে শাপলা দেশের বিলঝিলের সবখানে দেখতে পাওয়া যায় সেও অন্য প্রজাতির শাপলা, তা Nymphaea rubra, রক্তকমল বা লাল শাপলা। এটি অবশ্য আমাদের দেশজ উদ্ভিদ। সত্যিকার অর্থে শাপলাগুলোর ফুলের গড়ন এক হলেও মাঠপর্যায়ে এগুলোর আকার, দৈর্ঘ্যপ্রস্থ, রঙ, পাপড়ি ও বৃতিসংখ্যা, পাতার পুরুত্ব ও রঙ, আকার-আকৃতি, কিনারার কর্তিত ভাব ইত্যাদির দিকে নজর দিলে আলাদাভাবে চেনাটা খুব সহজ হয়ে পড়ে। 

শাপলা বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। কথায় আছে, মূল না তুলে ফেললে শাপলা অবিনাশী। উদ্ভিদটি পাতা ফুলসহ পানির ওপর ভাসে ঠিকই এর ঠাঁই কিন্তু মাটিতেই, পানির নিচের কাদামাটিতে। পঙ্কজটি মাঠঘাট শুকিয়ে গেলে পরের বছর ঠিকই আগের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াবে। যেসব জায়গায় পানি শুকায় না সেখানে কিন্তু সারা বছরই টিকে থাকে এটি। আমরা অবশ্য বর্ষাশরৎকালে এর সরব উপস্থিতি পাই, যখন ফুলের বন্যা আসে আমাদের অগভীর জলাভূমিগুলোতে। যদিও বলা হয়ে থাকে বছরজুড়েই শাপলা ফোটে। 

বছরের পর বছর শাপলা যে এক জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ায় তা কিন্তু তার গেঁড়ের (rhizome) জন্য। এই গেঁড় থেকেই ভুঁইফোঁড়টি ডাঁটা ও পাতা বের করে। কন্দের মতো দেখতে গেঁড়টি আনুভূমিকভাবে মাটিতে প্রোথিত থাকে। 

শাপলাপাতা বেশ সুন্দর; হতে পারে তা গোলগাল কিংবা তীরের ফলাকার, ডিম্ব-গোলাকার কিংবা মানবদেহের কিডনির মতো। কিনারা ঢেউ-খেলানো ও করাতের দাঁতের মতো গভীরভাবে কর্তিত, দেখতে কাঁটা-কাঁটা, গোড়ার দিকটা তাম্বুলাকার। পাতাগুলো বড়, ১৮-৪৮ সেমি ও ১২-৪২ সেমি, নতুন পাতার উপর-নিচ কালচে লাল, কালক্রমে তা গাঢ় সবুজ কিংবা ফিকে বেগুনি-সবুজে রূপ নেয়। পাতার উপরের অংশ চকচকে ও মসৃণ, নিচের অংশ মিহি ও সাদা রোমে আবৃত। পাতাগুলো যে সব সময় পানির ওপর ভাসমান থাকে তা কিন্তু নয়, পানির ওপর থেকে দেখলে বোঝা যায় কিছু পাতা পানির নিচে অবস্থান করে, যেগুলো কালক্রমে বড় হয়ে অদূর ভবিষ্যতে পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় থাকবে। 

পুরোপুরি ফোটা শাপলাফুল বেশ বড়ই বলা চলে; হতে পারে ৫-১৫ সেমি চওড়া, মাঝে মধ্যে ২৪ সেমি পর্যন্তও হতে পারে। বৃতি আয়তাকার, আগা সামান্য চোখা কিংবা ভোঁতা, ৫-১০ খণ্ডবিশিষ্ট। বৃতি সাধারণত সবুজ, তবে লালচেও হয়, যদিও তা বিরল। পাপড়িসংখ্যা ১৩-১৫, একেকটি ৪-৭ সেমি লম্বা, রৈখিক অথবা ডিম্ব-আয়তাকার। 

যেহেতু পানিতে ভেসে থাকতে হয় তাই পাতা ও ফুলের বোঁটা দুটিরই দৈর্ঘ্য হতে হয় প্রায় একই; এগুলো ৩৫-১৫০ সেমি পর্যন্ত দীঘল আর ১ সেমি পুরু। 

আগেই বলা হয়েছে, শাপলার রঙ তিনটি--সাদা, লাল আর লালচে আভার আরেকটি। এগুলোর প্রত্যেকটির পুংকেশর ১.৫-৩.৫ সেমি লম্বা; গোড়ার দিকে পুংদণ্ড প্রশস্ত, পরাগধানীতে কোনো উপাঙ্গ নেই; গর্ভপত্র ১.৫ সেমি লম্বা। ফুলে মৃদু গন্ধ রয়েছে। ফুলগুলো রাতে ফোটে আবার দিনের আলোর স্পর্শে ক্রমে বুজে যায়। তাই শাপলার আসল সৌন্দর্য দেখতে ভোরবেলায় নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো। আগেই বলা হয়েছে, সারা বছরই শাপলা ফোটে, তবে বর্ষার শেষে বা শরৎকাল থেকে শীতের আগ পর্যন্ত বেশি। বলা হয়, বর্ষায় পানি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে শাপলার 'ফুল ফোটানোর খেলা'ও বাড়তে থাকে। 

শাপলার ফল বেরি, ৩.৫-৫ সেমি ব্যাসের। পুংকেশরগুলো ভিন্ন অবয়বে ফলের গায়ে শক্তভাবে লেগে থাকে। ফলে কয়েকটা প্রকোষ্ঠ থাকে। অসংখ্য বীজ থাকে প্রকোষ্ঠগুলোতে। বীজ একেকটি ২ মিমি লম্বা, ডিম্বাকার, লালচে কিংবা কালচে। পানিতে ভাসমান অবস্থায় ফল বীজগুলো অবমুক্ত করে, যে-কারণে অনেক সময় শাপলার আশেপাশে ভাসমান অবস্থায় এগুলোকে দেখতে পাওয়া যায়। বীজ ও গেঁড় দিয়ে শাপলা তার বংশ বৃদ্ধির কাজটি চালায়।

ঢাকাশহরে শাপলার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে এক উদ্ভিদকর্মীকে আফসোস করে বলতে শুনি, 'ঢাকায় আসল হাতি নেই, আছে হাতির ভাস্কর্য, ঢাকায় জাতীয় ফুল শাপলা নেই, আছে এর ভাস্কর্য। আমরা প্রাণকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার প্রতিকৃতিকে আগলে  রাখছি।' কথাটা সত্যি। বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার মতো  বিল-ঝিল-নদীময় ঢাকাকে বানানো হয়েছে শুষ্কংকাষ্ঠং নিরস নগরে। এজন্য রাজউক নামের অথর্ব প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও অর্থলিপ্সা পুরোপুরি দায়ী, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকানগরে শাপলা নেই অথচ এর আশেপাশের গ্রাম-এলাকায় গেলে এর বিস্তর দেখা মিলবে। আর সারা দেশের অগভীর জলায় এখনো এর অঢেল দেখা মিলবে। বাংলাদেশ ছাড়াও একে পাওয়া যাবে ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, নিউগিনি ও ভিয়েতনামের জলজঙ্গলে। 

শাপলার প্রতিবেশীরা আমাদের কাছে কমবেশি পরিচিত। ঝাঁঝিদাম, কেশরদাম, টোপাপানা, ক্ষুদিপানা, কপিপানা, রক্তকমল, নীল শাপলা, পদ্ম, বড়নুখা, ছোটনুখা, কচুরিপানা, মালঞ্চ, সাচিশাক, কলমিলতা, ধইঞ্চা ও নানা প্রজাতির জলজ ঘাসের সহাবস্থানে শাপলা তার জীবনযুদ্ধ চালিয়ে নেয়।

আমাদের দেশের লোকেরা শাপলার গেঁড় ও ফুলের ডাঁটা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। বীজগুলো কাঁচা অবস্থায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা অহরহ খায়। ডাঁটা জনপ্রিয় সুস্বাদু সবজি হিসেবে দেশের বাড়িতে বাড়িতে খাওয়া চলে। ফুল দিয়ে মাঝে মধ্যে সাজসজ্জার কাজও চলে। গরম মাটির পাত্রে ভিজিয়ে রাখা শুকনো বীজ ভেজে খই হিসেবে কোথাও কোথাও খাওয়া হয়ে থাকে। এই খইকে বলে ঢ্যাঁপের খই। অখণ্ড বাংলা আর বিহার ও উড়িষ্যার লোকজন নাড়ু তৈরি করে এ ঢ্যাঁপের খই দিয়ে এবং বাজারেও তা বিক্রি হয় মাঝে মধ্যে। এ প্রসঙ্গে একটা চটুল বঙ্গদেশি প্রবাদবাণী মনে পড়ে গেল। কেউ হয়ত ন্যাকামি করছে, তার উচিত জবাব হিসেবে বিপক্ষের মুখরা কেউ বলে উঠল-- আহ্লাদী লো ঢ্যাঁপের খই!

সংস্কৃতসাহিত্যের বরাতে আমরা শাপলার একটি গুণকীর্তনকারী নাম পাই, সেটি কুমুদ। এ শব্দের ভাবার্থ, যে রাতে ফোটে আর দিনের আলোয় বুজে যায়। পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশপাশের লোকেরা শাপলাকে ডাকে শ্যাপলা, শালুক, কঁই, কঁইলাড়ি, সন্দশলাড়ি, নাল। আমাদের উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া লোকগানে শাপলার আরেক নাম হোলা। আমাদের দেশের কোথাও কোথাও এর লাল রঙেরটিকে লাল শাপলা, রক্তহালা, রক্তভাঙ্গা বলে ডাকা হয়, আর সাদাটিকে সাদা শাপলা।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শাপলার লাল রঙের ফুল রক্ত আমাশয় ও মেয়েদের জননেন্দ্রিয়জনিত জটিলতায় ব্যবহার করা হয়। লোকায়ত চিকিৎসায় এর আরো কিছু ব্যবহার রয়েছে। গেঁড়ের গুঁড়া পাইলস, ডায়রিয়া, বদহজম ও আমাশয়ে ব্যবহৃত হয়। শাপলার গেঁড় সংকোচক, জীনাণুনাশক, বেদনা উপশমকারী ও মূত্রবর্ধক।

Nympaheae pubescence বৈজ্ঞানিক বা দ্বিপদী নামের প্রথম অংশ এসেছে nymph শব্দের সূত্রে। শব্দটির অর্থ পবিত্র আত্মা, যে কিনা কুমারী, সে থাকে কোনো নদী, বন কিংবা অপরূপ কোনো স্থানে। আর pubescence শব্দটি এসেছে শাপলাপাতার তল ও শাপলার কাণ্ডে (সম্ভবত ডাঁটায়) সূক্ষ্ম রোমের উপস্থিতি থেকে।

ছবিস্বত্ব : নিজ

Comments

Popular posts from this blog

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

ঢাকার প্রাকৃত বৃক্ষ শাল

রসুন, Garlic, Allium sativum