অশোক
আমাদের দেশের অন্যতম সুন্দর ফুল অশোক। লাল, হলুদ কিংবা কমলা--উজ্জ্বল ও রঙিন আভায় চিত্রিত ফুল। শুধু রূপে নয়, গন্ধেও অশোক অনন্য। বলে রাখা ভালো, এটি আমাদের পাহাড়ি ফুল। এখনো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে এ ফুলের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। পাহাড়ের খাদে, পাহাড়ের উপরে কিংবা প্রস্তরখণ্ডের আশপাশে একে দেখতে পাওয়া যাবে। বসন্তকালে পাহাড়ে গেলে যে-কেউই একে দেখতে পাবে। অশোকের ফুল যেমন রূপময় তেমনি এর প্রস্ফুটন-ঐশ্বর্য। ফুলের মৌসুমের একেবারে শুরুর দিকে সারা গাছের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ফুল ফুটতে শুরু করে। এ জন্য খুব সহজেই ফুলে শোভিত গাছটি যে-কারোরই চোখে ধরা দেয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এ-কারণেই বলা হলো যে, শুধু ডালপালাতেই নয়, প্রধান কাণ্ড, এমনকি গাছের গুঁড়িতেও এর ফুল ফোটে। কিছু কিছু আবার অনেকটা মাটিলগ্ন অবস্থায়ও ফোটে।
কিংবদন্তিতুল্য ভারতসম্রাট অশোক-এর নামে এর নাম। কথিত আছে, তিনি এ গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছেন। অশোক কথাটার অর্থ আমরা সবাই জানি--শোক নাই যাতে, অর্থাৎ শোক বা দুঃখহারী। ঔষধি গুণ, পাতাবহুল্য, পাতার রাজসিক আবির্ভাব, নিবিড় ছায়াসুখ, ফুলের সৌন্দর্য আর মধুগন্ধিতার জন্য এর এমন নাম হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। এত যার গুণপনা, কিছু কিছু মানুষ বা প্রাণীর জন্য তা বিপজ্জনক হিসেবেও ধরা দিতে পারে। যেহেতু ফুল ফোটানাতে সে সেরা, সারা অঙ্গে যখন ফুল, তখন পোকামাকড় তো আসবেই। আর যদি পিঁপড়ার মতো খাদ্যলোভীর দল সেখানে হামলে পড়ে তা হলে তো কথাই নেই। সত্যি, অশোকের ফুলে ফুলে ঘোরে দংশনপ্রিয় পিঁপড়ার দল। বসন্তে-গ্রীষ্মে এর গাছে চড়া মানেই পিঁপড়াদলের কামড় খাওয়া। আপদ-বিপদের হাত থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতেই অশোকের এমন ব্যবস্থা। ফুলের গুণাগুণের কথায় ইতি। এবার আসা যাক গাছটির বর্ণনা প্রসঙ্গে।
শাখাপ্রশাখাবহুল গাছটি মাঝারি আকারের হয়। অতি পুরনো গাছও ২৫-৩০ ফুটের বেশি হয় না। এর মসৃণ কাণ্ড গাঢ় ধূসর রঙের।
এর প্রতি প্রত্রাক্ষে (পত্রধারী অণুডাল) পাতা থাকে ৫-৬ জোড়া, বিপ্রতীপ বিন্যাসে (পত্রাক্ষের বিপরীত পাশে একই বিন্দু থেকে উদ্ভূত)। একেকটি পাতার দৈর্ঘ্য ৫-১০ এবং প্রস্থে ২-৩ ইঞ্চি। পাতাগুলোর আকার অনেকটা বর্শার ফলা আকৃতির। মোট কথায় ডিম্বাকার-বর্শাকৃতির। পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙের। আর নতুন পাতা অসাধারণ বললে ভুল হবে, অদ্বিতীয়--সবুজে রূপান্তরিত হতে সে কয়েকটি রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। সাদা, লাল, তামাটে বর্ণ মেখে শেষমেশ চিরসবুজে আশ্রয় নেয় প্রাণের তাগিদে।
বাসন্তী ফুলের নতুনগুলো কমলা রঙের, একটু পুরোনো হলেই লাল রঙ ধারণ করে। এই ফাঁকে বলে নেয়া ভালো, অশোক একক ফুল নয়, মঞ্জরিবদ্ধ ফুল। অর্থাৎ, অনেকগুলো ফুল একত্রে মিলে একটি ফুলের গোছায় অবস্থান নেয়। ফুলগুলো অনেকটাই রঙ্গনের মতো বলে মাঝে মধ্যে লোকে ভুল করে। অশোকের পরাগকেশরগুলো বেশ লম্বা, ফুল থেকে বেশ উৎক্ষিপ্ত। এই পরাগকেশরগুলোর জন্য এর রূপ যেন উথলে ওঠে। এটি বাসন্তী হলেও কমবশি সারা বছরই দেখা মিলতে পারে। তবে আষাঢ়ের পর এর বিলয় ঘটতে থাকে।
অশোকের ফলগুলো শিমের মতো দেখতে, তবে তার চাইতে আকারে বেশ বড়; ৩-১০ ও প্রস্থে ১-১.৫ ইঞ্চি হয়। এগুলো কচি থাকতে লালচে রঙের হয়, তবে শুকালে গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করে। বীজ ৪-৮টি। বীজ কিংবা কলমে এর বংশবৃদ্ধি চলে। তবে বাড়ে অনেক সময় নিয়ে। এ জন্য বাগানিদের কাছে এ গাছ বেশ কদর পায়। দ্রুত বাড়া অন্য কোনো গাছ নিয়ে তাদের যে সমস্যায় পড়তে হয়, এটি নিয়ে সেটি হয় না। তাই ভবনসম্মুখে কিংবা দেয়াল ঘঁষে সামান্য জায়গাতে এ গাছের স্থান হয় খুব সহজেই। বসন্তসুখ উপলব্ধি করতে এ-গাছের বিকল্প খুব কমই আছে।
স্বর্ণ-অশোক
অশোক নিয়ে আমাদের দেশের লোকেরা একটু বিভ্রান্তিতে ভোগেন। অশোক, স্বর্ণ অশোক ও রাজ-অশোক নিয়ে অনেকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। প্রথম দুটি আলাদা করে চেনা আসলেই কষ্টের ব্যাপার। তবে শেষেরটির কিন্তু ফুল আলাদা রকমের, ফুলের সময়ে এদের পার্থক্য বোঝা যায় একটু ভালো করে লক্ষ করলেই।
আমাদের এই অশোক হলুদ-কমলা-লাল রঙের, স্বর্ণ অশোক তার নামেই বোঝা যায় এটি হলুদ রঙের হবে, সত্যি তা-ই। অবশ্য ফুল ছাড়া এ দুটি গাছ আলাদা করে চেনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শেষের অশোকটি রাজ-অশোক। এর ফুলের গড়ন প্রথম দুটির চাইতে একেবারে আলাদা। লম্বা ঝুলন্ত ডাঁটি বা মঞ্জরিদণ্ডে গাঢ় লাল ফুলগুলো সত্যি অসাধারণ। অশোক, স্বর্ণ-অশোক ও রাজ-অশোকের বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে
Saraca asoca, Saraca thaipingensis এবং Amherstia nobilis.
গাছটি চিরসবুজ হলেও শীতে একটু কাবু হয়ে যায়। রমনা পার্কের বিখ্যাত অশোকবীথি
বাংলার কবি-সাহিত্যকরা এর গুণপনায় মুগ্ধ। সংস্কৃত ও বৌদ্ধ জাতক-সাহিত্যে এর উল্লেখ রয়েছে ভুরি-ভুরি। রামায়ণে বর্ণিত সীতার বনবাসকালীন শোকের সাথে এটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রূপসীর পায়ের স্পর্শে বন্ধ্যা অশোকগাছে ফুল ফোটে বলে সংস্কৃত কবিরা কল্পনাপ্রবাসী হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায় রাশি রাশি উল্লেখ রয়েছেে এর। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ফুলগাছটি পবিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকে।
ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এর দেখা মিলবে। গাছটি দেখতে বেশ সুন্দর। পাতার নিবিড় বিন্যাস ও ঝোপালো চাঁদোয়া এর সৌন্দর্যের মূল কারণ। আমাদের দেশের বাগান, উদ্যান, উদ্ভিদ সংগ্রহশালা ও কিছু কিছু রাস্তার পাশে এর দেখা মিলবে। ঢাকার রমনা পার্কে এর চমৎকার একটা সারি রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশে অশোক শতবর্ষীও হতে পারে।
আমার ইউটিউব চ্যানেলের অশোক-এর ভিডিও দেখতে--
https://www.youtube.com/watch?v=Dv-ML6Lq4yc
Comments
Post a Comment