আম, Mango, Mangifera indica

আমফুলের কথা আমগাছের কথা
মোহাম্মদ আলি


শেখ সাদি ও তাঁর বন্ধু এক আমগাছতলায় বসে আছেন। পাকা আমের সময় তখন। গাছের নিচে অনেক পাকা আম পড়ে রয়েছে দেখে সাদি গপ-গপ করে তার কয়েকটি সাবাড় করলেন। এ দেখে তাঁর বন্ধু তাঁকে বেশ ভর্ৎসনা শুরু করল। সে বলল, যেই-না একটা ফল! এত মজা করে খাওয়ার কী আছে এতে? তাদের কথার কোন এক ফাঁকে এক গাধা গাছতলায় এসে হাজির। সে গাধা মাটিতে পড়ে থাকা পাকা আমগুলোতে মুখ দিয়ে নেড়েচেড়ে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতেই আমবিদ্বেষী বন্ধুটি ঠাট্টা করার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বলল, দেখলে তো, গাধা পর্যন্ত আম খেতে চায় না। আর তুমি...। তার কথা শেষ না হতেই সাদি মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন, ঠিকই বলেছ, একমাত্র গাধারাই আম খেতে চায় না। সত্য কি মিথ্যা, জানা যায় না, তবে আম নিয়ে এরকম গালগপ্পো প্রচলিত আছে অনেক। 


আমাদের দেশের দারুণ জনপ্রিয় একটি ফল আম। একে বলা হয় ‘ফলের রাজা’। আকার-প্রকার, রঙ, রস, স্বাদ, পুষ্টি—সবকিছু মিলিয়েই এই অভিধা এর। গাছটি বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ। তা হলেও এর ফুল যেন তেমন পাত্তার বিষয় নয় সাধারণের কাছে। বাঙালি কবিসাহিত্যিকরা অবশ্য এর ব্যতিক্রম। বাংলা-সাহিত্য তো বটেই, খোদ আমাদের জাতীয় সংগীতেই আমফুলের প্রশস্তি আছে।


সুগন্ধি ফুল হিসেবে আমের জুড়ি নেই। দারুণ মিষ্টি ও তীব্র সুবাস রয়েছে এতে। কিন্তু ফুল-বৈষম্যের শিকার সে। এর ফুলকে ফুল হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে একে বলা হচ্ছে—বোল, আমের মুকুল, আমের মঞ্জরি ইত্যাদি। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না আমের। কেননা ফাল্গুন আসলেই মুকুলিত আমগাছ জানিয়ে দেয় পৃথিবীতে বসন্ত ঝাঁপ দিয়ে নেমেছে। শুধু ফুল নয়, এর গন্ধ দিয়েও মাতিয়ে রাখে ‘ব্যাকুল অলিকুল’, অন্যান্য কীটপতঙ্গ, পাখি আর মানুষকে তো অবশ্যই। ফুলেল আমগাছের গন্ধভরা স্মৃতি বাঙালির এক অমোচনীয় অধ্যায়। এবার গাছটির সর্বাঙ্গের পরিচিতি তুলে ধরা যাক।


আমগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica, পরিবার Anacardiaceae. বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আমগাছের মাতৃভূমি। পৃথিবীর অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এটি সুলভ। গাছটি বিরাটাকারের হতে পারে, আবার মাঝারি আকারেরও হতে পারে। বিশালাকারের গাছের উচ্চতা ৪০ মিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে আমাদের আশেপাশের গাছগুলো সাধারণত ২০-২৫ মিটারের হয়ে থাকে। এর গুঁড়ি ধূসর অথবা কালচে এবং অমসৃণ কিংবা ফাটলযুক্ত। পাতাবহুল গাছটি বাংলাদেশের সবখানেই কমবেশি দেখা যায়। প্রিয় ফলদায়ী গাছ হিসেবে দেশের বসতবাড়িতে একে অহরহ রোপণ করতে দেখা যায়। পরিত্যক্ত বীজ থেকে অতি অবহেলাতেও অঙ্কুরিত হয় বলে ফলদ বৃক্ষ হিসেবে বোধ করি এর কদর আরও বেশি।


আমের পাতা কালচে সবুজ, মধ্যশিরা ও পার্শ্বীয় শিরাগুলোর বুনন গভীর। পাতা ছিঁড়লে বা মটকালে গাঢ় গন্ধ পাওয়া যায়, যা অনেকটা কাঁচা আমের মতো। পাতা মসৃণ, কিনারা মৃদু ঢেউ-খেলানো, ১২-২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৫-৭ সেন্টিমিটার চওড়া; একান্তর বিন্যাসী, অর্থাৎ ঘূর্ণিত—একটার পর একটা ডালে বিন্যস্ত; বৃন্ত বা বোঁটা ২.৫-৪ সেন্টেমিটার লম্বা। আমের নতুন পাতার রূপের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সারা বছরই নতুন পাতা দেয় গাছটি। একেক গাছে একেক রঙের কচিপাতার বাহার পাতা দেখা যায়। কোনোটিতে লালচে কিংবা তামাটে, কোনোটিতে হলুদ, আবার কোনোটিতে গাঢ় বাদামি রঙের ঝলমলে ঝিলিক। আমপাতার বোঁটায় বা অন্য অংশে আঠালো কষ থাকে, যেমন থাকে ফলের বোঁটায় কিংবা কাঁচা ফলে। এই কষ আবার বিভিন্ন প্রাণীর জন্য অস্বস্তিকর, এমনকি মানুষের জন্যও। আমের এই কষ মুখে লাগলে চুলকানি তো বটেই, ঘাও হতে পারে অল্পবিস্তর।


ফুলের রূপরস-বর্ণনা তো আগেই দেয়া হয়েছে। একেকটি ফুল খুবই ছোট, বাদামি কিংবা হলদেটে, খুবই সুগন্ধি; আকার-আকৃতি অনেকটা জামফুলের মতো। ক্ষুদ্র ফুলগুলো মিলে একেকটি বিরাট মঞ্জরি তৈরি হয়, এগুলো কাক্ষিক বিন্যাসের, অর্থাৎ ডালের কোণ থেকে তা গজায়। আমগাছে ফুল আসে শীতের শেষের দিক থেকে। সুগন্ধ ছড়ায় বসন্তে।

আমের ফলকে বৈজ্ঞানিক অভিধায় বলে ড্রুপ, (অর্থাৎ খোসা বা আবরণ পাতলা এবং শক্ত বীজের চারপাশে রসালো মাংসল অংশ দিয়ে ঘেরা ফল) আকার লম্বাটে অথবা গোলাকার; পাকা ফল হলুদ অথবা লালচে, কোনো কোনোটি সবুজ; রসালো ও সুগন্ধি। ফলের ওজন হতে পারে ১০০ থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত। ফল পাকে গরমে। এটি বাংলাদেশের প্রধানতম গ্রীষ্মকালীন ফল। কাউকে যদি বলা হয়, ৫টি ফলের নাম বল, তাহলে সবার আগে আমের নামটা উচ্চারিত হয়। আমের পরেই আসে অন্যান্য ফলের নাম (জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি)।


গাছের বংশবৃদ্ধির কাজটি চলে বীজ ও কলমের মাধ্যমে। গাছটির শিকড় মাটির অনেক ভিতর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। তাই এটি দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে এবং অবাক হলেও সত্যি অনুকূল পরিবেশ পেলে ৩০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে আমগাছ। ছোটবেলায় ঘোর বর্ষার দিনে স্যাঁতসেঁতে, ভেজা জায়গায় আমের আঁটি থেকে অঙ্কুরিত সতেজ চারা দেখে তেমন একটা পুলক বোধ না করলেও এখন এ বড়বেলায় সে-স্মৃতির ঘোর আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে; ভাবি, জীবনের কোনো শেষ নেই। রিলে রেসের মতো প্রাণ শুধু হাত বদল করে মাত্র!


কাঁচা আমের গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কী-না হয় এই কাঁচা আম দিয়ে! আচার, জেলি, জ্যাম, আমসত্ত্ব, আমসি, মোরব্বা তো হয়ই। এটি তরকারি হিসেবেও রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। ডালের সাথে কে-না খেয়েছে এই কাঁচা আম। কেউ কেউ একে বলে আমসি। পাকা আম দিয়ে তৈরি ফলের রস বা জুস সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়। জ্যাম-জেলি তো হয়ই।   

ফলের সুখ্যাতির জন্য সারা ভারতবর্ষে এর প্রায় ১০০০ রকমের জাত রয়েছে। আমাদের দেশেই প্রায় পাঁচশো জাতের আম চাষের কথা শোনা যায়। পঞ্চদশ-ষষ্ঠদশ শতকের মধ্যে এটি মুসলিম, পর্তুগিজ, ও স্প্যানিশ মিশনারির মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ও সংস্কৃত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আমের ভুরি-ভুরি উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত জাতকে এর উল্লেখ রয়েছে। মোঘলরা এর অনেকগুলো জাত তৈরি করেছিল।

এবার আমাদের দেশে চাষ হয় এমন কিছু জাতের নাম দেয়ার চেষ্টা করা যাক; নামগুলো বেশ মজার ও আদুরে--গোলাপভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি, খিরসাপাত, সূর্যপরি, বোম্বাই, হিমসাগর, কিষাণভোগ, আশ্বিনা, বারোমাসি, গুটি, কাঁচামিঠা, বৃন্দাবনি, কুয়াপাহাড়ি, রাজভোগ, মোহনভোগ, কহিতর, মিশ্রিভোগ, শ্রীধন, দুধিয়া, গোপালখাস, রুপালি, চোষা  ইত্যাদি।

আমের প্রাচীন নাম আম্র। এ ছাড়াও কিছু নাম রয়েছে এর, যেমন—রসাল, মাকন্দ, সহকার ইত্যাদি।

সবশেষে একটা মধুর ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ২০০২-০৩ সালের দিকে বেড়াতে গেছি বন্ধুর গ্রামের বাড়ি সন্দীপে। তখন শীতকাল। গ্রামের বাজার থেকে রাতে যখন ধানক্ষেতের বুক চিরে গুটিসুটি মেরে বেরুচ্ছি আমরা, তখন পিছন থেকে কিন্নরকণ্ঠে এক গান ভেসে এল : ও মঞ্জরী ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, আজ হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি? হতবাক হয়ে পিছনে ফিরে দেখি বন্ধুর কিশোরবয়সি কাকাত ভাই গেয়ে চলছে সে মধুরতম ফাগুনের গান। বেতারে রবিসংগীত-শোনা সে গ্রাম্য বালক কীভাবে মধুভাবে আয়ত্ত করল সে-গান, ভেবে এখনো সুখ পাই। আমের মঞ্জরী বলি, বোল বলি আর ফুলই বলি, আম-প্রসঙ্গ আসলেই রবিকিশোরের সে আশ্চর্য গায়নের অদ্ভুতসুন্দর ভালোলাগায় এখনো চোখ ভিজে যায় আমার। 

Comments

Popular posts from this blog

লাল সোনাইল, Java cassia, Cassia javanica

আকনাদি : পাতাগুলি যেন কথা

শিলকড়ই, Albizia procera